কোটা নিয়ে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে দেশে এক ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোটার দাবি পূরণের পর আরও ৯ দফা দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনকারীরা। এ অবস্থায় গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তার সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে আটক শিক্ষার্থীদেরও মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে আজ রোববার থেকে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চলমান পরিস্থিতি আলাপ-আলোচনা মাধ্যমে সুরাহার সুযোগ আর রইল না।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরপরই গতকাল শনিবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দু’দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঘোষণা অনুযায়ী, আজ রোববার রাজধানী ঢাকার সব ওয়ার্ডে এবং দেশের সব জেলা ও মহানগরীতে জমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। আগামীকাল সোমবার বিকাল তিনটায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত শোক মিছিল করবে দলটি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঢাকার সব ওয়ার্ডে এবং দেশের সব জেলা ও মহানগরীতে জমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে চলমান পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। এ অবস্থায় আজ সবার দৃষ্টি থাকবে রাজপথে। কী হতে যাচ্ছে আজ এ প্রশ্ন সবার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিষয়টি এখন আর কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আন্দোলনের ভাষা পাল্টে সরকার হটানোর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এখন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকার উদ্ভুত পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেয় তা দেখতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে মোকাবেলা করবে সেটি দেখতে হবে। নাকি কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে? পরিস্থিতি কী রূপ নেয় তা দেখতে সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় গত ১০ জুলাই। চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৪ জুলাই মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় বিক্ষোভ করে। রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও তালা ভেঙে বেরিয়ে আসে। গত ১৫ জুলাই সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ১৬ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিনই আন্দোলনকেন্দ্রিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞের। বহাল রয়েছে কারফিউ। কোটা সংস্কার দাবি পূরণ হলেও সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বেড়েছে আন্দোলনকারীদের দাবির সংখ্যা। বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের আন্দোলনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
আন্দোলন পরিস্থিতি : কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা গত শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং তাদের ৯ দফা দাবি আদায়ে আজ রোববার থেকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবেন। এদিকে নয় দফা দাবি আদায়ে তারা শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার। তাদের কর্মসূচি সফল করতে সর্বস্তরের মানুষকে এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তাদের নয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের পদত্যাগ। গতকাল শনিবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনকারীরা।
আলোচনার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর, প্রত্যাখ্যান আন্দোলনকারীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আলোচনায় থাকতে ১৪ দলীয় নেতাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
দেশের চলমান পরিস্থিতি শান্ত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার গণভবনে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, গণভবনের দরজা খোলা। কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমি বসতে চাই। তাদের কথা শুনতে চাই। আমি সংঘাত চাই না।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আটক সাধারণ ছাত্রদের মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রস্তাবিত পেনশন ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেন সরকারপ্রধান। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘যখন আমরা ডিবি হেফাজতে ছিলাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে ডিবি হেফাজতে অনশন করেছিলাম।’
আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত আসবে রাজপথ থেকে।’ গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার। তাদের কর্মসূচি সফল করতে সর্বস্তরের মানুষকে এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তাদের নয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের পদত্যাগ।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকাল শনিবার দলটির পক্ষ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, আজ রোববার সারা দেশের পাড়া-মহল্লায় প্রতিবাদ মিছিল করবেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এছাড়া কাল সোমবার বিকাল ৩টায় রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের সামনে শোক র্যালি করবে দলটি। এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে শনিবারের শোকমিছিল স্থগিত করে আওয়ামী লীগ।
নির্দেশের অপেক্ষায় আওয়ামী লীগের মাঠের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের মাঠের নেতাকর্মীরা। মাঠের নেতারা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা এখনও পর্যন্ত তারা পাচ্ছেন না। দুইদিন আগেই আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতাদেরকে ডাকা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। সেই সভা পণ্ড হয়ে গেছে।
জুলাই তাণ্ডবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের হতশ্রী অবস্থা ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে সাংগঠনিক শক্তি জোরদার করা, নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করাটাই অত্যন্ত জরুরি কাজ। এই কথা স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। আর এজন্যই যারা ত্যাগী, পরীক্ষিত ও রাজপথে আন্দোলন করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাদেরকে সামনে আনার তাগিদ অনুভব করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই সমস্ত নেতারা মাঠে নামতে পারেননি। তারা নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
]সুযোগ নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের রসদ বিএনপি-জামায়াত যোগাচ্ছে বলে আন্দোলনের শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের শুরুতে এই দু’টি রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বক্তব্য বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত ১৬ জুলাইয়ের পর আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। তাদের অংশগ্রহণে আরো জটিল রূপ ধারণ করে আন্দোলন।
গতকাল শনিবারও আন্দোলন অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি মহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, এই আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, ইনশাল্লাহ জনগণের বিজয় অবশ্যই হবে। ছাত্রদের বিজয় অবশ্যই হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, যৌক্তিক এই আন্দোলনে আমাদের শুধু সমর্থন নয়, আমাদের সব রকমের সহমর্মিতা, সহযোগিতা তাদের সঙ্গে থাকবে। দেশে আমাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাতে চাই, ছাত্রদের এই আন্দোলনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য।’
ভোরের আকাশ/মি