logo
আপডেট : ১২ আগস্ট, ২০২৪ ১৮:৫২
অনিশ্চয়তার পথে অর্থনীতি
নিখিল মানখিন

অনিশ্চয়তার পথে অর্থনীতি

দুঃসময়েও আরেক দফা অসহনীয় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশ। উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সব চেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। এ খাতের বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। পোশাক খাতের কিছু অর্ডার বাতিল হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে কিছু পণ্য আকাশ পথে পাঠানো হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সরকার পতনকেন্দ্রিক অরাজকতায় এই ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা; যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট বাজেটের ১৩ শতাংশের বেশি হবে। তারা বলছেন, করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষত রয়ে গেছে। ঝুঁকিমুক্ত হয়নি দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা। আন্দোলন ও সরকার পতনকেন্দ্রিক অরাজকতায় অনিশ্চয়তার পথে দেশের অর্থনীতি।

অর্থনীতিবিরা বলছেন, আন্দোলনের সময় দেশে উৎপাদন এবং অন্যান্য খাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব নয়। সরকারিভাবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ যে ব্যাপক এতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনের কারণে দেশের উৎপাদনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি অর্থনীতির সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। আর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সংকটকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। দেশের সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য ও আমদানি-রফতানি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, পোশাক খাত, রেস্তোরাঁ খাত পরিবতন খাত বেশি মাত্রায় অর্থনৈতিকভাবে অসহনীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে।

বিদায়ী আওয়ামী সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে পাস হয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট। বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী আন্দোলন ও সরকার পতনকেন্ত্রিক মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট বাজেটের ১৩ শতাংশের বেশি।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যে অবস্থা : তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে জীবনের বড় অংশ আজ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সব ব্যবসার ক্ষতি হলেও এ খাতের ক্ষতির পরিমাণ একটু বেশিই। কারণ যারা সফটওয়ার ব্যবসায় জড়িত তাদের ব্যবসার লাইফ লাইনই হচ্ছে ইন্টারনেট। কিন্তু অন্য ব্যবসার সাপোর্ট লাইন হিসেবে ইন্টারনেট কাজ করে। একইসাথে ই-কমার্স খাতও ইন্টারনেট ছাড়া চলে না।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে যে বাজার তৈরি করতে পেরেছে এবং বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে এবারের পরিস্থিতিতে সেটি অনেকটাই হুমকির মুখে পড়েছে। ইন্টারনেট না থাকার কারণে তাদের এবং ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করে কিছু জানাতে না পারায় যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তাতে তারা বিকল্প বাজারের দিকে চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা।

বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, দৈনন্দিন ক্ষতির চেয়ে এখন স্থায়ী ক্ষতি নিয়ে ভাবছি। কারণ ক্লায়েন্টরা আস্থা হারিয়েছে। আবার আস্থা অর্জন করে তাদের ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন ব্যাপার। এ খাতে বাংলাদেশে যে বাজার তৈরি হয়েছে এর বিকল্প হিসেবে এখন বিদেশি ক্লায়েন্টরা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকছে।

পোশাক খাতের অবস্থা : দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে কারফিউ এবং সরকার পতন পরবর্তী সময়ে বন্ধ হয়ে যায় পোশাক কারখানাগুলোও। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে সংকটে পড়ে এ খাত। এই সেক্টরের উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান সাংবাদিকদের বলেন, কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ইউনিট খোলা রাখলেও ইন্টারনেটের অভাবে ব্যবসা কার্যত থেমে ছিল। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শিপমেন্ট জমে গেছে, কারণ সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে কিছু কোম্পানির অর্ডার বাতিল হয়েছে। কিছু কোম্পানি আকাশ পথে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।

রেস্তোরাঁ খাতের অবস্থা : অস্থিরতা এবং কারফিউর কারণে রাজধানীর রেস্টুরেন্টগুলোকেও কঠিন সময় পার করেছে। কারফিউ শিথিল করা হলে ঢাকার ২৫ হাজার রেস্টুরেন্ট আবার তাদের কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু এখনো পুরোপুরি জমে উঠেনি ব্যবসা।

মিরপুরের একটি রেস্টুরেন্টের কর্ণধার শামীম ইসলাম বলেন, আগের মতো এখনো মানুষ আসছে না, কারণ এই আন্দোলনে মিরপুর একটা হট স্পট ছিল। ধীরে ধীরে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়েছে কিন্তু ওই যে আতঙ্কটা, কখন কী হয়, সেটা রয়ে গেছে।

আমদানি-রফতানি : দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ বন্দরের কার্যক্রম এক সপ্তাহের বেশি সময় বন্ধ থাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আমদানি কার্যক্রম ও পণ্য ডেলিভারি বন্ধ থাকায় এ খাতে ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল সাংবাদিকদের বলেন, একটা দিন ডেলিভারি বন্ধ থাকলে এর প্রভাব পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর পড়ে। পোর্টও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারণ আমাদের রেভিনিউ আমরা পাই নাই। আমাদের এখান থেকে যে পরিমাণ মালামাল ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। বন্দরে পড়ে রইল মালটা, ডেলিভারি করা গেল না, ফলে বর্তমানে তো ক্ষতি হলোই, ভবিষ্যতেও অর্ডারগুলোতে সমস্যা হতে পারে। ইমেজ, রেপুটেশন সবগুলো মিলেই ক্ষতি হলো। দেশের অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে আঘাত ফেলবে এটি বলে জানান মোহাম্মদ সোহায়েল।

ডলার সংকট : কোটা সংস্কারের আন্দোলন কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা সংঘাত, ইন্টারনেট না থাকা ও কারফিউ এবং সরকার পতন পরবর্তী কয়েকদিন ধরে অচল ছিল অথনৈতিক খাতের বড় অংশ। বেড়ে যায় ডলারের দাম। প্রায় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে এখন ১২৪-১২৫ টাকায় পৌঁছেছে। এর দুই সপ্তাহ আগেও ডলারের দাম ছিল ১১৮-১১৯ টাকা।

পরিবহন খাত : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানায়,সহিংসতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে পরিবহন খাত। শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে বন্ধ থাকে যান চলাচল। আর শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে নামে একদল দুর্বৃত্ত। ভাঙচুর ছাড়াও পুড়িয়ে দেয়া হয় বহু বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক। এরপর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেয়া কারফিউতেও বন্ধ থাকে গাড়ির চাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের হিসাব অনুযায়ী, দিনে যদি আট ঘণ্টা যান চলাচল ব্যাহত হয়, তাহলে গড়ে প্রতি কর্মঘণ্টার জন্য প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এর সঙ্গে আরো অনেক কিছু যুক্ত করার সুযোগ আছে। সঠিক সংখ্যার জন্য প্রতিটি খাত আলাদা করে হিসাব করা প্রয়োজন।

ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ : কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিবহনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিযোগের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকার পতনের পর কার্যত সরকারবিহীন চার দিনে দেশজুড়ে ঘটে অকল্পনীয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি সরকারি- বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনা। ঘটে লুটপাত। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় নেতাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা যা বলেন : বিশ্বব্যাংক, ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, প্রবৃদ্ধির চিন্তা না করে আগে অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। যা আছে, তা ঠিকমতো চলছে কি না, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এত দিন ইকোনমিক অঙ্গগুলো বিকল হয়ে ছিল। সেগুলোকে আগে সচল করতে হবে। ফ্যাক্টরি, দোকানপাট, বাস, ট্রাক, ট্রেন চালু আগে নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো চালু করার জন্য সবার আগে দরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঠিক করা। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তো আর ব্যবসা করতে পারবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান যাতে পর্যাপ্ত থাকে, সেটার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইন্সটিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি সাংবাদিকদের বলেন, অর্থনীতির আগের সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের যে প্রচেষ্টা ছিল এবারের ধাক্কা সেই প্রচেষ্টাকে আরো অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে। এই বিরূপ প্রভাবটা আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মূল্যস্ফীতি, উৎপাদনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা আরো প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা। সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আর্থিক এবং জানমালের ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা না হলেও এর পরিমাণ অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন মুজেরি।

 

ভোরের আকাশ/মি