- হামলা ও গোলাগুলি
- তারুল্য সংকট
- টাকা তোলার প্রবণা বৃদ্ধি
- মুখ ফেরানোর শঙ্কা
কাটছে না ব্যাংক খাতের দুর্যোগ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এই দুর্যোগের তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুণ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই খাতে চলছে মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। চাপের মুখে গণপদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। হামলা ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে। বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুপ্ত ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নিচ্ছে। অস্থির পরিবেশে আতঙ্কে আমানতকারীরা। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ ব্যাংকে তারল্যসহ নানা সংকট চলছে। এরই মধ্যে টাকা তোলার প্রবণতাও বেড়েছে। আস্থার সংকট তীব্র হলে ব্যাংকবিমুখ আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
করোনা ভাইরাস মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ ভূ-রাজনৈতিক কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশসহ বিশে^র অধিকাংশ দেশ আক্রান্ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সঙ্কট, স্থির প্রবাসী আয়, নিম্নগামী রিজার্ভ, মিশ্র রফতানি প্রবৃদ্ধি, অস্বাভাবিক খেলাপি, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপসহ আর্থিক খাতের সব সূচকই দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী। গত দেড় দশকে ব্যাংক খাতে দখল এবং অবৈধ নিয়োগ-পদোন্নতিসহ বিশাল অংকের অর্থ কেলেঙ্কারীর অভিযোগ রয়েছে। সরকার পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়ায় অস্থির হয়ে উঠেছে ব্যাংক খাত। একের পর এক বাণিজ্যিক ব্যাংকে চলছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ।
অস্থিরতা : সরকার পতনের খবর নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতেও লাগে অরাজকতার হাওয়া। সৃষ্টি হয় ব্যাংকে ব্যাংকে অস্থিরতা। অব্যাহত রয়েছে দখল ও পাল্টা দখলের খেলা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরদিন এস আলমের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে হয়। এরপর গত ৭, ৮ ও ১১ আগস্ট ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। গত বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে এস আলম গ্রুপ। গত রোববার ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। ব্যাংকটিতে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ৭ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ অন্তত ১০টি ব্যাংকে মালিকানার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।
ইউসিবির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পারটেক্স গ্রুপের এম এ হাসেম পরিবার মালিকানা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য গত বুধবার কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে মালিকানার পরিবর্তন চাওয়া হয়। এই ব্যাংকেও বিরাজ করছে অস্থিরতা।
মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে আইএফআইসি ব্যাংকেও। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলীর ফালুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদের কাছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এর নিয়ন্ত্রণ নেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি এখনো ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। গত রোববার প্রধান কার্যালয়ের সামনে ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেছেন। তারা বর্তমান চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের পরিচালকদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়।
এখনো প্রকাশ্যে কিছু না ঘটলেও মালিকানা দ্বন্দ্বে অস্থির হতে পারে এনআরবিসি ব্যাংক। ২০১৩ সালে ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালে চেয়ারম্যান ছিলেন ফরাছত আলী। ওই সময় ব্যাংকটিতে বেনামি শেয়ার ধারণ ও স্বাক্ষর জাল করে ঋণ অনুমোদনসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে। ওই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বসেন এস এম পারভেজ তমাল। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে তিনি জবরদস্তি করেছেন বলে আগের পরিচালকরা অভিযোগ তোলেন। পারভেজ তমালের সঙ্গে বিগত সরকারের বিভিন্ন মহলের ঘনিষ্ঠতার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
গত কয়েকদিন ধরে বেসরকারি খাতের ওয়ান, বাংলাদেশ কমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা ও ইনসেনটিভের দাবিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিন বলেন, ‘যেসব ব্যাংকের এখন সমস্যা তৈরি হয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদায়ী সরকারের আমলে মালিকানায় পরিবর্তন হয়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগের মালিকরা ফিরে আসতে চাইছেন; কিন্তু গুলি করে বা দখল করে তো ব্যাংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এজন্য প্রক্রিয়া আছে। সে প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। যদি সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় সাবেক মালিকদের কাছে ব্যাংক ফিরিয়ে দেবে, তাহলে সেটাও হতে পারে।’
পদত্যাগের হিড়িক : চাপে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত শুক্রবার তিনি পদত্যাগ করেন। যদিও সরকার পতনের পর তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকেই আসেননি। এছাড়া গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নরসহ চার শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগপত্র দিয়েছেন।
এই চারজন হলেন -ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও খুরশীদ আলম এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও পলিসি উপদেষ্টা আবু ফরাহ নাসের।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম গত শনিবার পদত্যাগ করেছেন। এরপর গত সোমবার দুই কমিশনার পদত্যাগ করেছেন।
তারা হলেন- কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও রুমানা ইসলাম।
লাগাতার আন্দোলন করেও বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম পদত্যাগ করছেন না। কয়েক দিনের মতো গতকাল মঙ্গলবারও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল এনবিআর। দাবি না মানলে আজ বুধবার থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা এসেছে। আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। গত বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
এভাবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চাপে পড়ে পদত্যাগের ঘটনা বেড়েই চলেছে। পদত্যাগের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে কাজের পরিবেশ। পাল্টা দখলের হুমকিও চলছে। অস্থির পরিবেশে ব্যাংকবিমুখ হচ্ছেন আমানতকারীরা।
আতঙ্কে আমানতকারীরা : ব্যাংক খাতের অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলায় আতঙ্কে আমানতকারীরা। অনেক সঞ্চয়কারী শঙ্কায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঝুঁকিতে এটিএম বুথে টাকা না পাওয়া, নগদ টাকা উত্তোলনের সীমা দুই লাখ টাকা বেধে দেওয়ায় দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটাতে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সংকট বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন,ব্যাংকের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন-গোলাগুলি কোনোভাবেই কাম্য নয়। যৌক্তিক দাবি-দাওয়া ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম মেনে দ্রুত সমাধান করা উচিত। না হলে আমানতকারীরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারালে সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ব্যাংকে বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কোনো কোন ব্যাংকের একটি পক্ষ অন্য সব ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের কোণঠাসা করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। সেটার কারণে অনেক অনিয়মও হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যেখানে হয়েছে সেসব জায়গায় বিক্ষোভ হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিক্ষোভ ব্যাংকের দরজায় না করে আলোচনার টেবিলে হওয়া উচিত। সেটা হতে হবে একটা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কর্মীদের অভিযোগ জানানোর একটা সঠিক প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে। যারা বিক্ষোভ করছে, ক্ষোভ প্রকাশ করছে তাদের হয়তো ইস্যুগুলো যৌক্তিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেও এই আলোচনাগুলো শুরু করে ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদে পরিবর্তন আসা দরকার।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে মালিকানা নিয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলন, নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে যাতে কেউ টাকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করা যাবে না। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন জমা দিচ্ছে না। এতে ক্রমে বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার পরিমাণ। অন্যদিকে আমানত প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, এত দিন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রসারে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক দশকের বেশি সময় ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/ সু