এবছর ভিন্ন আবহে পালিত হয়েছে জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট। সরকারি ছুটি ছিল না। নির্ধারিত স্থানে গিয়ে শ্রদ্ধা ও শোক জানাতে পারেনি দেশের মানুষ। দিবসটি পালনে গোপালগঞ্জ ছাড়া দেশের কোথাও দাঁড়াতেই পারল না আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীরা। গত বুধবার বিকাল থেকেই রাজধানীর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর এবং আশপাশের এলাকা ছাত্র আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে এই স্থানে ঢুকে ফুল দিতে এবং শোক প্রকাশ করতে পারেনি কেউ। যারা আশপাশে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের অনেকে মারধোরের শিকার হয়েছেন। এমনকি তাদের কাউকে হাত বেঁধে রাখার ঘটনা ঘটে। মুঠোফোন চেক করে করা হয়েছে হয়রানি। ছাত্র, বিএনপি ও জামায়াতের দখলে ছিল রাজপথ।
গতকাল জাতীয় শোক দিবস পালনে কোটা সংস্কার আান্দোলন এবং সরকার পতনের প্রভাব পড়ে। শোক দিবস পালনে ঘোর বিরোধিতা করেন বৈষম্য ছাত্র আন্দোলনকারীরা। সরকারি ছুটি বাতিল করে সরকার। শোক দিবস পালনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটে গতকাল বৃহস্পতিবার। রাজধানীসহ সারাদেশে দিবসটি ঘিরে বিরাজ করে আতঙ্ক। কর্মসূচি দিয়েও মাঠে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।
জাতীয় শোক দিবস ঘিরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীজুড়ে বিরাজ করে টানটান উত্তেজনা ও আতঙ্ক। গত বুধবার বিকালেই উত্তেজনার আভাস পাওয়া যায়। রাজধানীর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীসহ কয়েকজনের ওপর হামলা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির বাইরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে তারা মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করতে গিয়েছিলেন। কর্মসূচি শেষে ফেরার সময় গত বুধবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি শেষ হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন ব্যক্তি লাঠিসোটা হাতে রোকেয়া প্রাচীসহ অন্যদের ওপর হামলা চালান। আহত অবস্থায় রোকেয়া প্রাচীকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। হামলার ঘটনার পর গত বুধবার রাত নয়টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর রোড থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সংযোগমুখে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। ব্যারিকেডের ভেতর সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য অবস্থান নিয়েছেন। মূল সড়কে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে আশপাশে গেলেই তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে সায়েন্স ল্যাব, রাসেল স্কয়ার, ৩২ নম্বর, মেট্রো শপিং মলের সামনে, শুক্রাবাদ মোড় ও ২৭ নম্বর রাপা প্লাজার সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। কিছু সময় পর পর মিছিল নিয়ে বের হয়। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার ধানমণ্ডির ৩২ এসে জড়ো হয় তারা। আবার ধানমণ্ডি ৩২ লেক পাড়ও ছাত্রদের দখলে থাকে। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি ও পাইপ ছিল।
৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির প্রবেশ পথগুলারে সবটায় কাঁটাতারে ব্যারিকেড দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ৩২ নম্বরের সামনে অবস্থান করেন। এছাড়া বেশ কিছু পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্য মেট্রো শপিং মল মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখানকার বঙ্গবন্ধু ভবনের প্রবেশ সড়ক অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে দেখা যায়নি। তবে তারা আশপাশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে মিশে ছিল। আর দুই-একজন কালো পোশাকে আসলে তাদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি কয়েকজনকে মারধর করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় ৩২ নম্বর সড়কে এক যুবককে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে রিকশায় উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ হলেই ছাত্ররা মোবাইল ফোন চেক করেছে। ছাত্ররা ছবি তোলা বা ভিডিও না করতে হুঁশিয়ার করে দেয়। এমনকি সংলগ্ন সড়কে বাস থেকে কেউ ছবি তুললে বা ভিডিও করলেও বাস থামিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও নানা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর প্রাইভেটকার ভাঙচুর করা হয়েছে। কাদের সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকাল ৭টার দিকে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিতে পারিনি। দু-একজন সালাম দিয়ে ফিরে যেতে বলেছে। এটা খুবই ভালো লেগেছে। আবার আমি গাড়ির ভেতরে থাকা অবস্থায় কয়েকজন ঢিল ছুড়েছে, লাঠি দিয়ে গাড়ি ভেঙেছে। তারপর আমি চলে এসেছি। রগত ১৫-১৬ বছর আওয়ামী লীগ গায়ের জোরে চলেছে। আর এখনও চর দখলের মতো চলছে। এসব করলে জীবন দিয়ে ছাত্রদের আনা সফলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান কাদের সিদ্দিকী।
শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাড়া খেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য নিখিল মানখিন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। স্কয়ার হাসপাতাল পেরিয়ে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সামনে পৌঁছতেই তাড়া দেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি। সামনে এগোনোর অবস্থা ছিল না বলে জানান নিখিল মানখিন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার শোকাবহ দিনে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ জনকে একটি কলেজে ‘আটকে’ রেখেছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। পরে তাদের উদ্ধার করে গাড়িতে করে নিয়ে গেছেন সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা।
সকাল ৮টার দিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা অন্তত ৩০ জন নারী পুরুষের একটি দলকে কিল-ঘুষি মেরে, লাঠিপেটা করে নিউ মডেল কলেজে আটকে রাখা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
দুপুর পৌনে ১টার দিকে সেনাবাহিনীর চারটি এবং বিজিবির একটি গাড়ি নিউ মডেল কলজের সামনে এসে থামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমেই হুইসেল বাজিয়ে কলেজের সামনে থাকা আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেন। পরে কয়েকজন সেনাসদস্য কলেজের ভেতরে ঢুকে আটকে থাকা ব্যক্তিদের বের করে গাড়িতে তোলেন। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ৯ জন নারী এবং দুটো গাড়িতে ২০ জনের বেশি পুরুষকে তোলা হয়। এরপর গাড়িগুলোকে পান্থপথের দিকে চলে যেতে দেখা যায়।
বিএনপি-ছাত্রদলের অবস্থান :
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বায়তুল মোকাররমÑ গুলশান ও ধানমণ্ডিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এছাড়া নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নেয় দলটির নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে রাজধানীর এসব স্থানে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জমায়েত হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি। এছাড়া গত বুধবার রাত থেকেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থান নেয় ছাত্রদলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী।
শেখ হাসিনাসহ তার দোসদের যথাযথ বিচারের দাবিতে ১৫ আগস্ট বায়তুল মোকাররম ১নং গেট থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু। সাইন্সল্যাব থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম। দুটি স্থানেই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীরা অবস্থান করেন।
জামায়াতের মতবিনিময় :
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মগবাজারে দলীয় কার্যালয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ১২ দলীয় জোটের মধ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জনগণের ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাকার হয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত আমরা মোকাবিলা করব।
তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর ধরে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসকের অবসান ঘটেছে। এ দিনটিকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। এজন্য তরুণসমাজকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
জামায়াত আমির বলেন, হাজার প্রাণের বিনিময়ে আমরা এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। দেশ গড়ার কাজে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ১২ দলীয় জোট, আলেম সমাজের কী ভূমিকা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি জনগণের ঐক্য সুদৃঢ় হবে এবং ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাকার হয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত আমরা মোকাবিলা করব।
১২ দলীয় জোট প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, জাতির এক ক্রান্তিকাল যুগসন্ধিক্ষণে আমরা জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের দপ্তরে এসে মতবিনিময় করেছি। জাতীয় জীবনে বিরাজমান সংকটে একটি ধাপ আমরা অতিক্রম করেছি কিন্তু বাকি রয়ে গেছে আরও অনেক সমস্যা। এ সংকট মোকাবিলা করার জন্য আগামী দিনে একসঙ্গে আমরা কীভাবে অগ্রসর হতে পারি সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও মাওলানা আ.ন.ম শামসুল ইসলাম (সাবেক এমপি), সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আব্দুর রব।
ভোরের আকাশ/ সু