পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের দেশে নতুন নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে; তারা পুলিশকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন যেন তাদের রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়। বিগত ১৬ বছরে বিরোধী দলের ওপর পুলিশ যে স্ট্রিমরোলার চালিয়েছে; তা ভাষায় বর্ণনায় করার মতো না। পুলিশের এই ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে দেশি-বিদেশি অনেক মানবাধিকার সংস্থা। শুধু তা-ই নয়; পুলিশের কতিপয় সদস্য ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপহরণ, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। তাদের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ সব বিষয়ে বার বার পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যক্তির অপকর্মের দায় বাহিনী নেবে না। তবুও বেপরোয়া ছিল পুলিশের কতিপয় সদস্য। শীর্ষ স্থানীয় অনেক কর্মকর্তা বিশেষ করে সদ্য চাকরিচ্যুত ডিবির হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আন্দোলন দমাতে অনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে রাজনীতিকদের আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে চাপ প্রয়োগ, নির্যাতন এবং আবার খাবার খাওয়ার ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতেন। এ নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। এই ঘটনাকে জাতির সঙ্গে রশিকতা বলেছেন হাইকোর্ট। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বিভাগে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা। টানা তিন দিন পুলিশের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত শুক্রবার থেকে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ না দিলে পলাতক ঘোষণা করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর পুলিশের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আইজিপি বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৪২ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। সরকার পতনের পর নিজেদের জীবন বাঁচাতে বেশকিছু পুলিশ সদস্য নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ জনরোষে পড়ার ভয়ে ইউনিফর্ম পরে বের হতে চাচ্ছেন না। তাদের শঙ্কা ও ভয় কাটছে না। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুলিশবাহিনী বিতর্কিত হয়েছে তাদের অপসারণের দাবিতে ঢাকার রাজারবাগসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন বিক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরা। তাদের দাবি, গত ১৫ বছরে যারা পদোন্নতি পাননি ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আবার যারা মহাজোট সরকারের আমলে পদোন্নতি পাননি তারাও একজোট হয়েছেন। তারা নবনিযুক্ত আইজিপির কাছে দাবি জানিয়েছেন, যাতে এসব সমস্যার সমাধান করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানামুখী জটিল সমস্যার সম্মুখীন। এই জটিলতা নিরসন করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন সরকার এলেই এমন জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু এবার পুলিশের জটিলতা একটু ভিন্ন। তারা মাঠপর্যায়ে পুলিশের দাবি-দাওয়া ও দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনছেন। তারা আশা করছেন দ্রুতই সংকট কেটে যাবে। থানার কার্যক্রম পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। সব জেলার পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটির প্রধান লক্ষ্য হবে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো।
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক আইজিপি মো. ময়নুল ইসলামও দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছেন, আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বল প্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে সরকারদলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে অতি উৎসাহী একটি অংশ দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় থেকেছে। সংগত কারণেই পুলিশের মধ্যে অসন্তোষ এবং গ্রুপিং তৈরি হয়েছে।
পুলিশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরাতে এই বাহিনীর পুনর্গঠন প্রয়োজন। তবে এ সংস্কার বাস্তবায়ন হতে পারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে। বর্তমান পুলিশ বাহিনীতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে সেটি থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রথমত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। বাহিনীর মধ্যে অতি উৎসাহী গোষ্ঠীর তৎপরতা নিবৃত্ত করতে হবে। পুলিশ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এই বাহিনীর অনেকে মানসিক অস্বস্তিতে রয়েছেন। তাই সাধারণ মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। পুলিশ জনগণের বন্ধু, জনগণের সেবক, এই প্রত্যয় নিয়ে একটি জনবান্ধব বাহিনী গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
ভোরের আকাশ/মি