logo
আপডেট : ১৭ আগস্ট, ২০২৪ ১৩:১১
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের নিবন্ধ
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের মিত্ররা কি চীনমুখী?
ভোরের আকাশ ডেস্ক

শেখ হাসিনার পতনের পর
ভারতের মিত্ররা কি চীনমুখী?

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর নয়াদিল্লি তার ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এতদিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ভারত যে কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল, এ ঘটনায় সেখানে চীনের প্রভাব বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের ফেলো নীলান্তি সমরনায়েক বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। এ কথা স্পষ্টত বলাই যায়, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার প্রধানদের মধ্যে দিল্লির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং স্থায়ী সম্পর্ক ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে। বাংলাদেশ ছেড়ে হাসিনার পলায়ন ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্ককে অধিকতর জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে যথেষ্ট সময় লাগবে। আর এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভারতের সমর্থন প্রয়োজন হবে।

ভারতের ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ পররাষ্ট্র নীতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে সূচনা করেন। যার লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান দুই বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চিরাচরিতভাবে ভারতের পরিবর্তে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বাংলাদেশে চীনের প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। গত মে মাসে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি জানিয়েছিল, তারা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একটি যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করবে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ চীনের অস্ত্র রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, এর পরিমাণ প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতি একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছে।

ভারতের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক নাতাশা আগরওয়াল এক বিশ্লেষণে বলেন, চীনের মতো ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে প্রতিবেশীদের প্রতি দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গিতে শুধু ‘অহঙ্কার’ স্থান পেয়েছে। নাতাশার পরামর্শ, এই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ঠেকাতে গেলে ভারতকে তার প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে ভারসাম্য আনতে হবে। স্বাধীন এবং সম্মিলিতভাবে ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভবত ভারতের জন্য তার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে।

জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের প্রতিবেশী নীতি টালমাটাল হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি পরিবর্তিত এবং উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তার জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য দিল্লিকে অনুরোধ করেছেন শ্রী রাধা। তিনি বলছেন, ভারতকে প্রতিবেশী প্রথম নীতি থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই সেই নীতি মেনে চলতে হবে। এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও ভারতকে দেখতে হবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কতটা ভালো কাজ করা যায়। এমনকি ভালো সময়েও চীনের দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জ আসতে পারে সে বিষয়ে ভারতকে সচেতন থাকতে হবে।

সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, দিল্লির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির বিষয়বস্তু এবং প্রয়োগ অভারসাম্যপূর্ণ ছিল। ভারতের এই নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিবেশীদের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সক্ষমতা তৈরি করা। ভারত বিশ্বাস করে, নিজেদের স্বার্থেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত। যাতে সীমান্ত অঞ্চলগুলো জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মতো ভারতবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত না হয়। এটি একটি উইন-উইন পার্টনারশিপ।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব অনিল ত্রিগুনায়াত বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান এবং সম্ভবত পরবর্তী নেতৃত্বের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত কিছু ধারণার কারণে ভারতের প্রতি স্বল্প সময়ের জন্য নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে। তবে উভয় দেশের জনগণের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। তাই দুই দেশের মধ্যে যেকোনো মন কষাকষি দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে না।

নিবন্ধটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটে সহায়তা করার পরে, ভারত একটি চীনা পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প অবরুদ্ধ করে এবং নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কায় নোঙর করা চীনা গবেষণা জাহাজে আপত্তি জানায়। তবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যখন মোদি ভারতের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের আগে কাচাথিভু দ্বীপের ওপর অধিকার দাবি করে একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। যা ভারতের কংগ্রেস পার্টি ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কার কাছে হস্তান্তর করেছিল। মাল্লীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু যিনি ভারতবিরোধী প্ল্যাটফর্মে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই ভারতীয় সৈন্যদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। চীনের সঙ্গে আরো শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করেন।

নেপালের কে পি শর্মা অলি, যাকে চীনপন্থী বলে মনে করা হয় এবং আগে আঞ্চলিক বিরোধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যার দ্বন্দ্ব ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসেছেন। ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও উত্তেজনাপূর্ণ।

চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ নয়। ভুটান ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জোটবদ্ধ। যদিও অনেকে মাল্লীপের বিদেশি সামরিক উপস্থিতি বন্ধ করার এবং প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের জন্য তার অভ্যন্তরীণ নীতির সমালোচনা করেছে, তবুও নতুন সরকার একটি সংশোধিত আকাশ নিরাপত্তা সহযোগিতা কর্মসূচিতে ভারতের বেসামরিক উপস্থিতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল।

সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউট দ্বারা প্রকাশিত স্টেট অব সাউথইস্ট এশিয়া ২০২৪ সমীক্ষা অনুসারে, ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সবচেয়ে কম কৌশলগতভাবে প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের মধ্যে একটি, যখন চীনকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি হিসেবে দেখা হয়। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্কট লুকাস জোর দিয়েছিলেন যে, ভারতের আঞ্চলিক অবস্থান শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে তার নিজস্ব স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির ওপর।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তার কারণে আঞ্চলিক দেশগুলো এখনো ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। মাল্লীপের প্রসঙ্গ তুলে কুগেলম্যান বলেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দিল্লির উদ্বেগের প্রতি আরো সহনশীল অবস্থান গ্রহণ করেছে দেশটি এবং সপ্তাহান্তে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘গভীর’ করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সফরকে স্বাগত জানিয়েছে। একই সঙ্গে কুগেলম্যান মনে করেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করতে পারে। তবে বাণিজ্য এবং পানি বণ্টনের মতো ব্যবহারিক বিষয়গুলো উভয়ের মধ্যে একটি কার্যকর সম্পর্ক পরিচালনার মাধ্যম হতে পারে।

 

ভোরের ‍আকাশ/মি