শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশ ও জনপ্রশাসনে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের আলোচিত শীর্ষ বেশ কয়েকজনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বদলি করা হয়েছে অনেককে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ এবং বিপ্লব কুমারের খোঁজ নেই। তারা কোথায় আছেন; তা কেউ বলতে পারছেন না। তাদের ‘ব্যাপার আলাদা’ বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে সকল পুলিশ সদস্যকে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল দিলেও আলোচিত ওই দুইজন কাজে যোগ দেননি।
সরকার পতনের ঠিক দুই দিন আগে হারুনকে গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস এবং বিপ্লব কুমার সরকারকে প্রশাসন ও গোয়েন্দা দক্ষিণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা বিদেশে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে থানা এবং পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চলে। আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্যে কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে ঢাকা। পুলিশবিহীন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাতের বেলা টানা কয়েকদিন চলে ডাকাত আতঙ্ক। ডাকাত ঠেকাতে রাত জেগে রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দেয় সাধারণ মানুষ।
ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, ডিএমপির প্রায় সকল সদস্য এরই মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তারা এখনো কাজে যোগ দেননি। আর তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইতোমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়েছে ঢাকায়। তার মধ্যে কয়েকটি মামলায় হারু ও বিপ্লবের নামও এসেছে আসামির তালিকায়। ঢাকা মহানগর পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই দুইজনের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য মেলেনি। তারা কোথায় আছেন তাও জানাতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মামলা যেহেতু হয়েছে, সেহেতু তাদের আর কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং তাদের গ্রেপ্তার করাই এখন পুলিশের লক্ষ্য। এরই মধ্যে হারুনের গাড়ির খোঁজে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার খিলক্ষেতে ‘লেকসিটি কনকর্ড’ আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। সেখান থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একজনকে আটকও করা হয়েছে।
২০১১ সালের ৬ জুলাই বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক সংসদ ভবনের সামনে পুলিশের পিটুনির শিকার হন। সেসময় তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশীদ এবং অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ওই ঘটনার নেতৃত্ব দেন। জয়নাল আবেদন ফারুককে ধাওয়া করে জামা খুলে নেওয়ার একটি ভিডিও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছাপা হলে তা ভাইরাল হয়। এরপর থেকেই এ দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব পুলিশ বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। ২০তম বিসিএস ক্যাডারে পুলিশের চাকরি নেওয়া হারুন ১৯৯৮ সালে ছাত্রলীগের বাহাদুর-অজয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একসময় চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগে কয়েক বছর দায়িত্ব পালনের পর গাজীপুরের পুলিশ সুপার হন তিনি। সেখানে কয়েক বছর দায়িত্ব পালনের মধ্যে ২০১৮ সালের মে মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় বিএনপি তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তোলে। এরপর ওই বছরের আগস্টের শুরুতে তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশে বদলি করা হয়। একই বছরের ২ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে হারুনকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করে সরকার। নারায়ণগঞ্জে ১১ মাসের দায়িত্বে সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেন হারুন। হকার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তিনি যেমন প্রশংসিত হন, তেমনি নারায়ণগঞ্জের অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে ‘টক্করে’ গিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেন। ২০১৯ সালে পারটেক্স গ্রুপের কর্ণধার এম এ হাশেমের ছেলে আমবার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজের স্ত্রী ও সন্তানকে আটক করেও আলোচনার জন্ম দেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে আনা হয়েছিল। পরে আবার তাকে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ডিআইজি হিসেবে ২০২২ সালের ১১ মে পদোন্নতি পাওয়ার পর একই বছর ১৩ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে ঢাকার ডিবির দায়িত্ব পান। এর আগে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্ব পাওয়ার পর ডিবি অফিস পরিচিতি পায় ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ হিসেবে। এর কারণ, হারুন তার কার্যালয়ে অভিযোগ নিয়ে আসা বিভিন্নজনকে দুপুরে খাওয়াতেন। সেসব ছবি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করে তিনি আলোচনার জন্ম দেন।
সবশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে ডিবি কার্যালয়ে কয়েকদিন আটকে রাখেন হারুন। তাদের অ্যাপায়ন করার একটি ছবি আবার আলোচনা তৈরি করে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করে বলে, ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না। এরপরই গত ৩১ জুলাই তাকে ডিবি থেকে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্সে বদল করা হয়। বদলির পর থেকে নিশ্চুপ ছিলেন তিনি। পবর্ততীতে বিপ্লবের ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা শোনা না গেলেও হারুন গাজীপুর এবং নারায়ণ গঞ্জের পুলিশ সুপার থাকাকালে বেশ আলোচনায় আসেন। অন্যদিকে ২১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে চাকরি নেওয়া বিপ্লব সরকার ছিলেন ছাত্রলীগ জগন্নাথ হল শাখার সেক্রেটারি। পুলিশের চাকরিতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরোটা সময় তিনি দাপুটে কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ভোরের আকাশ/মি