১. বান্দরবানের লামা উপজেলার নানা পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে জুমের জমিন এবং পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র জবর-দখল করে রাবার বাগান করার জন্য তৎপর নানা কোম্পানি। এমনি এক পাহাড়ের ম্রো নাম সরই হুং (সরই পাহাড়)। সরই হুংয়ের প্রায় ৪০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ও জুমজমিন দখল করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি। পাহাড়ের ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এই কোম্পানি। আদিবাসীরা যাতে এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় ঝিরির পানিতে বিষ দেয়। পৃথিবীর প্রাচীন এক পত্রঝরা শালবন মধুপুর। ১৯৫০ সাল থেকে রাষ্ট্র এই বনের সঙ্গে অন্যায় করছে। বনবিভাগ দেওয়াল তুলে বনকে বন্দি করতে চেয়েছে। মান্দি-কোচ আদিবাসীরা বন বাঁচাতে লড়াই করেছে। পুলিশ ও বনবিভাগের গুলিতে শহীদ হন পীরেন স্নাল। ভূমি দখলের জন্য লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় নওগাঁর ভীমপুর। জমি বাঁচাতে শহীদ হন আলফ্রেড সরেন। পাহাড় থেকে অপহরণ করা হয় কল্পনা চাকমাকে। ঝরা শালপাতা কুড়ানোর জন্য গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় শিশিলিয়া স্নালের শরীর। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করে চিনিকল। ভূমি রক্ষার আন্দোলনে শহীদ হন শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু ও মঙ্গল মার্ডী। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন অভিনাথ ও রবি মার্ডী। মৌলভীবাজারে নাহার, বনাখলা, আগর, কাঁকড়াছড়া, ঝিমাই খাসিপুঞ্জির পানজুম ও বাগান ধ্বংস করে চাবাগান। কেবল ভূমিদখল, উচ্ছেদ বা নিপীড়ন নয়; আদিবাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রের উপস্থাপন প্রবলভাবে বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে জাদুঘর কিংবা তথাকথিত সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে আদিবাসী জীবন ও ইতিহাসকে ‘নিষ্ক্রিয় অবজেক্ট’ এবং ‘অপর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ‘ভাত, পিঁপড়া ও মদ’ লেখার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র আগ্রাসী স্বাদ পায়। উন্নয়ন, আগ্রাসী গাছের বাগান, বাণিজ্যিক পর্যটন, বিনোদনকেন্দ্র, জলপাই বাহাদুরি, ইকোপার্ক, বহুজাতিক খননের নামে আদিবাসী বসতি ও জীবন বারবার ছিন্নভিন্ন হয়। রাষ্ট্র আদিবাসী হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, হামলা ও ভূমিদখলের কোনো বিচার করেনি। আদিবাসীদের সামনে রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ জারি রেখেছে। এমনকি আদিবাসীরা নিজের নামে নিজেদের ডাকতে পারেন না। রাষ্ট্র না করেছে বারবার। গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে নিষেধ করেছে। বৈষম্যমূলক পরিচয় নির্ধারণ করে রাষ্ট্র আদিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছে। বৈষম্যহীন এক রাষ্ট্র রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে এখন। ফ্যাসিবাদী খবরদারিতে আদিবাসী জনগণকে ‘বাঙালি কর্তৃত্ববাদ’ সামাল দিতে হয়। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদকে যারা প্রশ্ন করেন তারাও অধিকাংশ সময়ে আদিবাসী আয়নাতে নিজের চেহারা দেখতে ভুলে যান। রাষ্ট্রকে আদিবাসীমুখী হিসেবে সংস্কার করতে হবে। আদিবাসী জীবনের অমীমাংসিত জিজ্ঞাসাগুলোর মীমাংসা থেকেই রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটবে। গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আদিবাসী জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টাসহ প্রায় বহু উপদেষ্টাই আদিবাসী জনগণের ন্যায়বিচারে সক্রিয় ছিলেন। উপদেষ্টাদের অনেকেই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নিজেরা সর্বদা ‘আদিবাসী’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। আমরা চাই আদিবাসী জীবনে ঘটে যাওয়া ও ঘটমান সকল অমীমাংসিত অন্যায়ের মীমাংসায় ভূমিকা রাখবেন সরকারের এই উপদেষ্টারা।
২. কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কেন আদিবাসী পরিচয়কে মানতে নারাজ? এ বিষয়ে এখনো রাষ্ট্রের কোনো বিশদ ব্যাখা বিশ্লেষণ আমরা শুনিনি। অধিপতি রাষ্ট্রের এই আচরণ বৈষম্যমূলক, তবে সর্বোপরি ‘অসাংবিধানিক’ নয়। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান আদিবাসী আত্মপরিচয় অস্বীকার করে। এমনকি সংবিধানে নেই এমন পরিচয় রাষ্ট্র তার প্রকল্প, প্রতিষ্ঠানের নাম এবং কর্মসূচিতে বহাল রাখে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে উল্লেখ আছে, ...রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি নেই। এমনকি সংবিধানে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ প্রত্যয়টিও নেই। সংবিধানে আছে ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নয়। কিন্তু সরকারিভাবে বহুল ব্যবহৃত প্রত্যয়টিই হলো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এমনকি এই নামে একটি রাষ্ট্রীয় আইন, বহু সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প রয়েছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ অনুযায়ী ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে ওই আইনের তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণকে বোঝানো হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ‘দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো’। বহু নথি, কর্মসূচি, বক্তব্য, ঘোষণা ও দলিলে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি উচ্চারিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসলেও রাষ্ট্রের তরফ থেকে নানা সময় ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়খানি ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনে সংবিধান রচিত হলেও আদিবাসী আত্মপরিচয়কে আড়াল করে সংবিধানে সকলের পরিচয় নির্ধারিত হয় ‘বাঙালি’। ১৯৭২ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর প্রতিবাদ জানান এবং সংসদ বর্জন করেন। ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ থেকে জানানো হয় দেশে কোনো আদিবাসী নেই। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো ১৯ এপ্রিল ২০০৬ তারিখের চিঠিতে আদিবাসী শব্দটির পরিবর্তে ‘উপজাতি’ লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, দেশে উপজাতি আছে কিন্তু আদিবাসী নেই। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘আদিবাসী’ সম্বোধন না করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত এক বার্তায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী দেশের আদিবাসী জনগণকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় না দেওয়ার কথা বলা হয়। ২০২২ সালের ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে টেলিভিশন টকশোতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। আদিবাসীরা কোনো জাতির ‘উপ’ নন, এমনকি নৃগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা বলতে বাঙালিসহ আদিবাসীদেরও বোঝায়। তাহলে আদিবাসী আত্মপরিয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ এক প্রবল বৈষম্য জারি রাখে। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো আদিবাসী আত্মপরিচয়কে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ একক আত্মপরিচয় হিসেবে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে যার নজির ও নথি আছে। জাতিসংঘ প্রদত্ত ‘ইনডিজেনাস পিপলস’-এর সংজ্ঞায়নের সঙ্গে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়ের মিল আছে। রাষ্ট্রকে আদিবাসী জনগণের আদিবাসী আত্মপরিচয়কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সংবিধানের ২৩ক ধারা সংশোধন করে লিখতে হবে, ...রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি, মাতৃভাষা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রথাগত সামাজিক আইনের অধিকার সুরক্ষা, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থাগ্রহণ করিবেন’।
৩. ‘আদিবাসী’ এবং ‘আদিবাসিন্দা’ এক নয়। একজন আদিবাসিন্দা আদিবাসী নাও হতে পারেন, আবার আদিবাসীরাও সব অঞ্চলের আদিবাসিন্দা নন। এই ভূগোলে বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্তার জনগণ তাদের একক সাংস্কৃতিক শ্রেণি পরিচয় হিসেবে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি জাতিরাষ্ট্রসমূহ গঠিত হওয়ার বহু আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছেন। জাতিরাষ্ট্র গঠনের পূর্ব থেকে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরেও যেসকল সমাজ নিজস্ব প্রথাগত শাসন কাঠামো, ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচালিত হয় তারাই আদিবাসী। বাংলাদেশে আদিবাসী প্রত্যয়টির বহুল প্রাচীন ব্যবহার আছে। ১৯৪৪ সালে নওগাঁর বদলগাছিতে ‘পাহাড়পুর/সোমপুর বৌদ্ধ বিহারের’ কাছে নির্মিত হয় ‘পাহাড়পুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়’। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, শেরপুরের শ্রীবরদীর বাবেলাকোনা আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের খৈচালা আদিবাসী রেজি বে. প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিনাজপুরের কাহারোলের সাধনা আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বটতুলী আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নওগাঁর ধামইরহাটের সোনাদীঘি আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোনো সংগঠন, বিদ্যায়তন বা জাতিসংঘ কেউ একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন সব শিক্ষালয় গড়ে তুলেনি। আদিবাসী নাম নিয়ে এসব বিদ্যালয় গড়ে ওঠেছে একেবারেই স্থানিক সামাজিক তৎপরতা হিসেবে। নামকরণের এই ধারা সমাজ-শ্রেণি কী বর্গে বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তির এক মৌলিক সাংস্কৃতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। ১৯৬২ সালে মধুপুর শালবন দখলের পাকিস্তানি বলপ্রয়োগ শুরু হলে স্থানীয় আদিবাসীরা যে ঘোষণাপত্র তৈরি করেন তার প্রথমেই ছিল, ‘আমরা মধুপুর গড়ের আদিবাসী জনগণ’। নওগাঁর ধামইরহাটের জগদল আদিবাসী স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন দেশে, ১৯৭২ সালে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের ‘শালবনের রাজা’ গল্পেও ‘আদিবাসী’ আছে। ‘দেশে আদিবাসী নাই’ এই ধরনের প্রবল কর্তৃত্ববাদী ন্যারেটিভ বদলাতে হবে। আদিবাসী ও বাঙালি জনগণ মিলেই এ দেশের কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, সংস্কৃতি ও উৎপাদন খাতকে সমুন্নত রাখছে। কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রামী ভূমিকা ও রক্তজয়ী অবদান আছে। বাংলাদেশ এক বহু জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও পেশার দেশ। রাষ্ট্রের রূপান্তর প্রক্রিয়াকে এই বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্রের সকল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্বীকৃতি ও সম্মানসহ আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বাংলাদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা এবং মোট জাতিসংখ্যা নিয়ে তর্ক আছে। অস্পষ্ট পরিসংখ্যান ও খতিয়ান আছে। ১৯৮৪ সালের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৮ জন এবং তখন মাত্র ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয় ১২ লাখ পাঁচ হাজার ৯৭৮ জন এবং জাতিসত্তা দেখানো হয় ২৯টি। প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে একটি জাতিগোষ্ঠী বেড়ে যায়। ২০০১ সালের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা উধাও ছিল। সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রায় ত্রিশ বছরে জাতিসত্তা বেড়ে হয়েছে ৫০টি। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ ভাগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। যদিও রাষ্ট্রীয় জনশুমারিতেও এই কডা, রেংমিটচা ও সৌরা জাতিগোষ্ঠীর নাম নেই। রাষ্ট্র চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মান্দি, সাদ্রিÑ এই পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু করেছিল। কিন্তু যে ১৪টি আদিবাসী ভাষা বিপন্ন সে সব ভাষা সুরক্ষায় কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ তৈরি হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টার সংস্থা গ্রামীণ ট্রাস্ট বাংলাদেশে প্রথম আদিবাসী মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু করেছিল। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের মাধ্যমে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাঁওতাল শিশুদের জন্য এটি ‘পরী টুডুর বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র এই বিদ্যালয়টি চালু রাখতে পারেনি, মানসিক যন্ত্রণায় পরী টুডু এখন অসুস্থ। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা বিপন্ন আদিবাসী মাতৃভাষা সুরক্ষার উদ্যোগগুলো আগে নেওয়া জরুরি। যত দেরি হবে তত হারাতে থাকবে এক একটি মাতৃভাষা। রাষ্ট্রের আমূল সংস্কারে আদিবাসী ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবন দর্শন এবং উৎপাদনব্যবস্থার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে হবে।
৫. বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আদিবাসী অধিকার সুরক্ষায় দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব এমন কিছু প্রস্তাব রেখে চলতি আলাপখানি শেষ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকমিশন সক্রিয়করণসহ সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক স্বাধীন সক্রিয় ভূমি কমিশন গঠনের মাধ্যমে আদিবাসী অঞ্চলে সংগঠিত সকল ভূমিদখল ও ভূমিবঞ্চনার অবসান করতে হবে। আদিবাসী জনগণের প্রথাগত ভূমি অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইনের সুস্পষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী জনগণের জুম, কৃষি, কুটিরশিল্প, প্রাকৃতিকসম্পদ নির্ভর জীবনব্যবস্থাকে আইনগতভাবে স্বীকৃতিসহ রাষ্ট্রীয় সহায়তা চলমান রাখতে হবে। আদিবাসী অঞ্চলে যেকোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা, স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণের আগে অবশ্যই আদিবাসী সমাজের পূর্ণ সম্মতি ও মতামত পেতে হবে। সেক্ষেত্রে সকল তথ্য ও পরিকল্পনা অবাধ, উন্মুক্তভাবে আদিবাসী জনগণের সঙ্গে সহজভাবে জানাতে হবে। প্রাণপ্রকৃতি ও আদিবাসী জীবনসংস্কৃতি বিপন্নকারী সকল বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্র, আগ্রাসী গাছের মনোকালচার কিংবা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। আদিবাসী অঞ্চলে নানা সময়ে সংগঠিত প্রতিটি খুন, গুম, ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ড, হামলা, জবরদখল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আদিবাসী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী জনগণের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট ‘কোটা ব্যবস্থার’ বহাল করতে হবে; যা অনগ্রসর করে রাখা আদিবাসী জনগণকে রাষ্ট্রের মূলধারায় যুক্তকরণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে কাজ করবে। আদিবাসী শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎসাহিতকরণের ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে পদক, সম্মাননা এবং নানা ক্ষেত্রে দুস্থ শিল্পীদের জন্য সম্মানজনক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। লেখক : গবেষক।
ভোরের আকাশ/মি