logo
আপডেট : ১৯ আগস্ট, ২০২৪ ১২:২১
অন্তর্বর্তী সরকার
শুরুতেই অনৈক্যর আভাস
সিরাজুল ইসলাম

শুরুতেই অনৈক্যর আভাস

দেশের ক্রান্তিকালে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই অনৈক্যর আভাস পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশে আসে। দেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আবদান নিয়ে একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তার ওপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শীর্ষ নেতারা সাখাওয়াতের ওপর ক্ষুব্ধ হন। তাদের পক্ষে থেকে উপদেষ্টা সাখাওয়াতকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে। এ দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা বিক্ষোভ-মিছিল ও সমাবেশও করেন। এর প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। দপ্তর বদলের পর তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধের তিনি এখনো উপদেষ্টা পরিষদে আছেন। তিনি পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ক্ষোভ ঝরেছে সাখাওয়াতের কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হলে চলে যাবেন। আওয়ামী লীগের অবদানের কথা বলা-ই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবির নিন্দা জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়।

গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এম সাখাওয়াত হোসেনকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে এসেছেন লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এতে মন খারাপের কিছু নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আমার যতটুকু করার সাধ্য ছিল, করে আসছি। শুক্রবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়েছে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং আরও ১৩ উপদেষ্টার সঙ্গে শপথ নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। ১২ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ওইদিন আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়া আওয়ামী লীগকে গণ্ডগোল না পাকিয়ে নতুন মুখ নিয়ে দল গোছানো পরামর্শ দেন তিনি। দেশের জন্য আওয়ামী লীগের অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা অনেক বড় পার্টি। আই হ্যাভ লট অব রেসপেক্ট ফর আওয়ামী লীগ। একসময় বাঙালিদের ভরসার জায়গা ছিল এই পার্টি। বায়ান্ন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবদান ব্যক্তিগত কোনো কারণে নষ্ট করবেন না। এটা জাতীয় সম্পদ। আপনারা আসুন। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে বলব এমন কিছু করবেন না যাতে জীবন বিপন্ন হয়। আপনারা রাজনৈতিক দল হিসেবে দলকে গুছিয়ে নিন। নির্বাচন হলে অংশ নিন। তবে প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখলে হাজার-হাজার মানুষের রক্ত ঝরবে। সেই সঙ্গে ভারতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, আপনি ভালো থাকেন, আবার আসেন। আমরা সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গণ্ডগোল পাকানোর মানে হয় না, এতে লাভ হবে না। বরং লোকজন আরও ক্ষেপে উঠবে।

ওইদিন তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিক্ষোভ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আজকের উপদেষ্টাদের কেউ-কেউ ‘খুনিদের’ পুনর্বাসন করার বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনি উপদেষ্টা হয়েছেন। ‘খুনি’ হাসিনাকে পুনর্বাসনের বক্তব্য যারা দিতে চায়, আমরা ছাত্র-জনতা যেভাবে তাদেরকে উপদেষ্টা বানিয়েছি, ঠিক একইভাবে গদি থেকে ছুড়ে নামাতে দ্বিধা করবো না।

এদিকে, ওইদিন রাতেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপির সহযোগী সংগঠন; জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। সন্ধ্যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা।


সরিয়ে দেওয়ার দাবি ছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দলের গত সোমবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠক হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

বৈঠক শেষে একাধিক নেতা উপদেষ্টা এম সাখাওয়াতকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, আমরা তার (এম সাখাওয়াত) এমন বক্তব্য নিয়ে কনসার্ন (অবগত)। রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টি বৈঠকে উত্থাপন করেছেন। ছাত্রনেতারা তার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাকে অপসারণের দাবি জানান। আমরা আজ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, এম সাখাওয়াতের বিষয়ে গুরুতর আপত্তি জানানো হয়েছে। তার একটি বক্তব্যে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যে ক্ষেপে গেছে। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। তার বক্তব্যে ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।

আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, বৈঠকে এম সাখাওয়াতের বিষয়টি তোলেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান। তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ চেয়েছেন। জবাবে উপদেষ্টারা বিষয়টি আলোচনা করে দেখবেন বলে জানান।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান সদস্য ২১ জন। তারা হলেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়); আলী ইমাম মজুমদার (প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত); মো. ফাউজুল কবির খান (বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়); লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়); সালেহ উদ্দিন আহমেদ (অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়); আসিফ নজরুল (আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়); আদিলুর রহমান খান (শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়); রিজওয়ানা হাসান (শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়); নাহিদ ইসলাম (ডাক টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়); আসিফ মাহমুদ (যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়); ফারুকী আজম (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়); ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন (বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়)।

প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ছাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয় জনতা। পরে ওই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন টানা ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা। ওই আন্দোলনে ৬৫০ জন নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে জাতিসংঘ। তবে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ভারতের নর্থইস্ট নিউজকে বলেছিলেন, নিহতের সংখ্যা হাজার খানেক হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আহত অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তারা মারা গেছেন। ফলে তাদের হিসাব সরকারের কাছে নেই।

 

ভোরের আকাশ/মি