ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরে কর্মবিরতিতে ছিলেন নন ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগের পর দায়িত্বে ফিরে এলেও অনেকটাই তারা মনমরা। গত দেড় দশকে তাদের আচরণে যে দাপট দেখা যেত; সেটি এখন নেই বললেই চলে।
অনেকেই বলছেন, আন্দোলনে সহকর্মীদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার বিষয়টি এখনো পুরোপুরি ভুলে গিয়ে কাজ করতে পারছেন না তারা।
সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি থানা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। দেশের প্রায় প্রতিটি থানায় পৌঁছে গেছে পুলিশ। ধীরে ধীরে স্বাভাবিকও হয়ে আসছে থানার কাজ। তবে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য ও কর্মব্যস্ততা নেই। সহকর্মীদের হারানোর শোক, ভয় ও আতঙ্ক এখনো তাদের পিছু ছাড়ছে না। ফলে তারা অনেকটাই মনমরা।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার রোষানলের শিকার হয়েছেন শত শত পুলিশ সদস্য। তবে পুলিশ বলছে, ক্ষয়ক্ষতির পিছনে ছাত্রদের কাঁধে ভর করে হীন স্বার্থ হাসিলে দুষ্কৃতিকারীরাই এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তারাই পুলিশের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে।
রাজধানীর মতিঝিল থানায় কর্মরত সাব-ইন্সপেক্টর অনিল রায় দৈনিক ভোরের আকাশ’কে বলেন, পুলিশ বাহিনীতে আগেও হতাশা ছিল; এখনও আছে। যদি এভাবে চলতে থাকে; তাহলে হতাশা আরও বাড়বে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রণীত আইন দিয়েই আজও আমাদের কর্মব্যবস্থাপনা নির্ধারিত হয়। এ কারণে জনগণের সঙ্গে পুলিশের পারস্পরিক সমঝোতা গড়ে ওঠে না। তিনি জানান, বাংলাদেশে দুই লক্ষ বার হাজারের কিছু বেশি পুলিশ সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে বিসিএস ক্যাডার আছেন মাত্র চার হাজারের মতো। এই চার হাজার দ্বারাই পরিচালিত হয় পুরো পুলিশ বাহিনী। শৃঙ্খলার কারণে তাদেরকে মানতে হয়। যদি সকল নীতিনির্ধারণী সভায় পুলিশের সকল শাখা থেকে প্রতিনিধি রেখে মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; তাহলে একটি সর্বসম্মত এবং মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু তা না করে সিংহভাগ পুলিশ সদস্যকে পাস কাটিয়ে ঔপনিবেশিক কায়দায় আমাদের ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, আবার কোন সরকার যেন নিজেদের প্রয়োজনে পুলিশকে ব্যবহার না করতে পারে; এটিই আমাদের এখন সবচে বড় দাবি। এজন্য পুলিশের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন কিংবা সেনাবাহিনীর মতো পুলিশকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিকে পুলিশ কিভাবে মোকাবিলা করছে জানতে চাইলে মতিঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) রাসেল হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরাও এদেশের মানুষ, আমাদের ছেলে মেয়েরাও এখানে লেখাপড়া করে। আমাদের মধ্যে অনেকের সন্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। সে কারণে আন্দোলনে আমাদেরও মৌন সমর্থন ছিল। তিনি বলেন, পুলিশ জনরোষের শিকার হয়েছে উপরস্তদের নির্দেশ পালন করার কারণে। পুলিশ সব সময় জনগণের সেবা প্রদানে অঙ্গিকারাবদ্ধ। কিন্তু যারা পুলিশকে পরিচালনার দায়িত্বে থাকে, যে নিয়মে পুলিশকে পরিচালিত করা হয়। তাদেরকে এবং সেই নিয়ম আগে সংষ্কার করতে হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহতদের মধ্যে অনেক পুলিশ সদস্য রয়েছেন। কিন্তু সব পুলিশ অপরাধী না। অথচ এসব পুলিশ হত্যার ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি এখনো। তিনি বলেন, আমরা বিশ^াস করি, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ধ্বংসাত্মক ছিল না। তৃতীয় একটি দুষ্কৃতিকারী গোষ্ঠী এ সকল হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। যদি এখন এসকল হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার না হয়; তবে পুলিশ আর কখনো জনগণের জানমালের হেফাজত করতে পারবে না। অপরাধীরা সুযোগ পেলেই পুলিশের ক্ষতি করতে থাকবে। রাসেল বলেন, আমরা আশা করবো বিগত সরকার পতনের আগে এবং পরে যত পুলিশ-ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে, সকল খুনের তদন্ত করবে বর্তমান সরকার।
অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো অনেকেই বারবার তাদের নিহত সহকর্মীদের ছবি নিজের কাছে থাকা মোবাইলে দেখেন। তারা ছাত্র আন্দোলনের সময়টাকে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্ন হিসেবে ভুলে যেতে চান। বারবার চেষ্টা করার পরও সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে জনরোষের শিকার হয়ে পুলিশ বাহিনীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, পুলিশ এখনো জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য তারা কিছু পুলিশ সদস্যর অতি উৎসাহকে দায়ী করছেন। এ ধরনের পুলিশ নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে রাজনৈতিক দলের সেবক হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। এছাড়া পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য, সেবা প্রদানে ঘুষ গ্রহণ, প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করে নির্দোষকে ফাঁসানোর মতো কর্মকাণ্ডকে সামনে আনছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশের পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কখনোই খুব সুখকর ছিল না। ঘুষ দুর্র্নীতিতে নিমজ্জিত পুরো বাহিনীর এই চরিত্র যদি বদলানো না যায়; তবে কাক্সিক্ষত দেশ গঠন সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ভোরের আকাশ’কে বলেন, পুলিশ যেন তার পেশাগত দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারে সেই জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার আপামর জনগণের সহযোগিতা। এছাড়া পুলিশকে তাদের দায়িত্বে মনযোগী হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার; কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সব কিছু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর পরিচ্ছন্ন ইমেজ তৈরি এবং বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে কমিটি গঠিত হয়েছে। খুব শিগগিরই পুলিশ তাদের দায়িত্বে স্বপ্রতিভ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/মি