চাকরিতে কোটা সংস্কারে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে একক কর্তৃত্বের শাসনে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার ঘটনা ঘটিয়ে বিশ^বাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। বিশে^র কোন দেশের শিক্ষার্থীরা এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে সক্ষম হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই বিশে^র মানুষ এখন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের প্রশংসার তারিফ করছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ও ভারতসহ বিশে^র অনেক দেশই এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তারাও বাংলাদেশের মতো দৃষ্টান্ত রাখতে চায়। এতে প্রমাণ করে যে শুধু লেখা পড়াতেই সীমাবদ্ধ নয় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অসম্ভবকে সম্ভব করে দিতেও পটিয়শী। আর এই নজির নতুন বলে আমরা মনে করি না। বাংলাদেশের ইতিহাস স্বাক্ষ্য বহন করে এই ছাত্র আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্রদের সংগঠিত একটি আন্দোলন। তারপর থেকে যত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, সব আন্দোলনেই ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এইভাবে ছাত্রদের রক্তের উপর কেউ থাকতে পারেনি, যার সর্বশেষ উদাহরণ কোটা আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ উৎসর্গ করে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করেছে শিক্ষার্থীরা। পাকিস্তানি শাসকদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে আন্দোলন করে সফলতা বয়ে এনেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালে মুক্তযুদ্ধে বিজয় ও ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছে এই ছাত্ররা। সব আন্দোলনেই রক্ত ঝরেছে। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও নব্বুই সব গণঅভ্যুত্থানে রক্ত ঝরেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত বেশি রক্ত ঝরেনি। আন্দোলনকারী, পথচারী, ছাত্রলীগ ও পুলিশ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। এবার চাকুরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে বিশ^বাসীর প্রশংসার দাবিদার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ। এখন তাদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের মেধাবী ছাত্ররা। আসুন আমরা তাদের এই কর্মতৎপরতায় উৎসাহ দেই, প্রেরণা জোগাই, সহযোগিতায় পাশে দাঁড়াই। তবেই তাদের আগামী দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে হরে সফল।
আমরা জানি, দুর্নীতিতে বিশ^ রেকর্ড গড়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশ। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এদেশ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধে বসেছে। এমন কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি নেই। একারণেই যে আমরা বিশে^ও সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবার পথে দিনদিনই পিছিয়ে পড়ছি। প্রশাসন, সমাজ, কর্মক্ষেত্রসহ সবক্ষেত্রে বিরাজমান এই দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত উন্নয়নের আশা করা যায় না। কাজেই তারুণ্যেও অহংকার ও আমাদের আগামী দিনের কর্ণধার মেধাবী শিক্ষাথীদের নেতৃত্বে নতুন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে আগে নিতে হবে জোরালো পদক্ষেপ। এজন্যে প্রয়োজন দেশের সর্বক্ষেত্রে সংস্কার। দুর্নীতি, লুটপাট, দখলবাণিজ্য, সন্ত্রাস, অর্থপাচার, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, জুলুম ও অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে জোরালো কর্মসূচি দিয়ে সফলতা বয়ে আনবে এই তারুণ্যের অহংকার ছাত্রসমাজ। সেই বিশ^াস আমাদের রয়েছে। আমরা চাই দুর্নীতি ও দু:শাসন মুক্ত দেশ তথা সমাজ ব্যবস্থা। শুধু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না, আমাদের দেশের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য বিরাজমান সেই বৈষম্য নিরসনেও নিতে হবে পদক্ষেপ। ছাত্ররা এই বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ নিবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে দেশবাসী অপেক্ষার প্রহর গুণছেন দেশের আবাল বৃদ্ধ জনতা। সেই প্রত্যাশা পূরণেও জেগে উঠবে ছাত্ররা সেই অপেক্ষায় দিনগুণলাম আমরা।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন আছে, আছে উদ্যম ও সাহস। তারা প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেলে যেকোন অসাধ্যকে সাধ্য করতে সক্ষম বলে আমরা বিশ^াস করি দেশ ও জাতীয় স্বার্থে প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে তারই দৃষ্টান্ত রাখছে শিক্ষার্থীরা। শুধ যে দেশেই তারা অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে তা আমরা মনে করি না। বিশে^ও বিভিন্ন দেশে শিক্ষা নিতে গিয়েও আমাদের মুখকে উজ্জ¦ল করে তুলছে। বিদেশ বিভুইয়ে শিক্ষা নিয়েও নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলছে। বিদেশে বড় বড় পদে চাকরি করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিশ^বাসীর কাছে উজ্জ¦ল করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে উন্নয়ন বয়ে আনছে।
আমরা জানি, ২০১৭ সালের মার্চে একটি সংবাদপত্রের উদ্যোগে বাংলাদেশে ১ হাজার ২০০ তরুণের মধ্যে একটি জরিপ করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় ৮২ শতাংশ তরুণই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৬৩ শতাংশই বলেছিলেন, তারা জানেন না তাদের জীবনের লক্ষ্য। ৫৬ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্ন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে অধিকাংশ তরুণ অনাগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। কারণ রাজনীতি মানে বিদ্বেষ, আন্দোলনের নামে হয় নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। আমাদের তরুণ এই ছাত্র সমাজ সেই জরিপকে মিথ্যা পমাণিত করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধেী আন্দোলনের মাধ্যমে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নয়। তারা নিজেদের ভবিষৎ পরিকল্পনায় এখন আর উদাসীন নয়। তবে আমাদের বিশ^াস যে, এই তরুণ সমাজ শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতেও পদক্ষেপ নিবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এটা ভেঙ্গে পড়লে সেই জাতির আর রক্ষা নেই। বিগত সরকারগুলোর আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন নতুন কারিকুলাম চালু করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছেন বলে অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ খুবই চিন্তিত। তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুধু হতাশাগ্রস্ত বললে কম বলা হবে। তারা উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোরালো পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমরা জানি, যে জাতি যত শিক্ষিত সেই জাতি তত উন্নত। বিশে^ দিকে তাকালে সেই নজিরই আমরা দেখতে পাই। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে ধবংসের পথে ঠেলে দিয়েছে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কাজেই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশে^ সাথে তাল মিলিয়ে নতুন করে সাজাতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ^ মানের করতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশ বিভূইয়ে চড়া মূল্য দিয়ে লেখাপড়া করতে যাওয়ার প্ররণতা কমে আসবে। সাশ্রয় হবে আমাদের অনেক টাকা। এটা করা সম্ভব হলে বিশ^মানের শিক্ষা দেশেই পাবে শিক্ষার্থীরা। একই সাথে টেকনিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ১৫ হাজার ২৩৬। তাদের মধ্যে অধ্যাপক রয়েছে ৪ হাজার ৬৬১ জন। তাদের পরামর্শ নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজ সেটা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আমাদের বিশ^াস।
দেশে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে দীঘর্ দিনে আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা থেকে জাতি আজ অনেক দূরে সরে গেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। দীর্ঘদিনেও তা বন্ধে নেয়া হয়নি জোরালো কোনো পদক্ষেপ। ফলে এসব সমস্যা দিন দিনই প্রকট হয়ে উঠেছে । এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না। এসব সমস্যার মূলোৎপাটনে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ সমাসন্ন। আর সেটা তরুণ ও মেধাবীরাই করতে পারবে সেই বিশ^াসও আমাদের রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। এদেশের ছাত্র ও মেধাবী তরুণদেরকেই সেই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দুর্নীতি, দু:শাসন, নিপিড়ন নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
ভোরের আকাশ/মি