logo
আপডেট : ২৩ আগস্ট, ২০২৪ ১৪:৫৩
শেরপুরে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনন্য ‘রাজিয়া সামাদ ডালিয়া’
আমিরুজ্জামান লেবু, স্টাফ রিপোর্টার, শেরপুর

শেরপুরে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অনন্য ‘রাজিয়া সামাদ ডালিয়া’

ক্যাপশন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ করছেন রাজিয়া সামাদ ডালিয়া

শেরপুরে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন রাজিয়া সামাদ ডালিয়া আপা। দীর্ঘদিন সমাজসেবায়যুক্ত রাজিয়া সামাদ উপজেলা পর্যায়ে "শ্রেষ্ঠ জয়িতা" সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সর্বশেষ সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব ‘দিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার’ লাভ করেন।

১৯৪৩ সালে ১ ডিসেম্বর শেরপুর শহরের খরমপুর মহল্লায় খান বাহাদুর ফজলুর রহমান ও লুৎফুন্নেছার ঘর আলোকিত করে দুনিয়ায় আসেন মহিয়সী নারী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া। তাঁর বাবা ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার চীফ হুইপ। শেরপুর শহরে তাঁদের বেশিরভাগ জমিজমা সামাজিক ও মানবতার কাজে দান করা হয়েছে।

রাজিয়া সামাদ ডালিয়া শুধু একটি নাম নয়, আদর্শ ও অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতা নিবেদন করে যাচ্ছেন একটি আলোকিত সমাজ গড়ার জন্যে। আরাম আয়েশের জীবন চালনার সকল আয়োজন ও উপাত্তকে ছুড়ে ফেলে তিনি বেছে নিয়েছেন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং আলোকিত সমাজ গড়ার কাজ। গরীব অসহায় রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রথমে নিজ বাসায় গড়ে তোলেন শেরপুর ডায়াবেটিস সেন্টার। এছাড়া শিশুদের প্রতিভা বিকাশের জন্য "পাতাবাহার খেলাঘর আসর"নামে শিশু কিশোরদের জন্য নিবেদিত একটি সংগঠন।

শেরপুরে ১৯৭২ সাল থেকে এ সংগঠনটি শিশুদের প্রতিভা বিকাশে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টিনের ভাঙা চাল দিয়ে পানি পড়ে। বর্ষায় পোকা-মাকড়ের ভয় বেড়ে যায়। এজন্য খেলাঘরের কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় পাকা দালান ঘর নির্মাণ করা হবে। কিন্তু অর্থের অভাবে দালান নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।তখন এ কাজে এগিয়ে আসেন রাজিয়া সামাদ ডালিয়া। তিনি একটি বিরাট অংকের অর্থ তুলে দেন খেলাঘর কমিটির হাতে।

সাহসে ভর করে পাতাবাহার খেলাঘর আসরের ঘর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলে পুরোদমে। বর্তমানে বিল্ডিং ঘরে খেলাঘরের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে।প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

এদিকে, সংস্কৃতি চর্চায়ও রাজিয়া সামাদ ডালিয়া আপার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শেরপুরে জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদ শেরপুর জেলা শাখার তিনি প্রতিষ্ঠা সভাপতি। এছাড়া সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), মাদক বিরোধী আন্দোলন শেরপুর, রক্ত সৈনিক বাংলাদেশ, খান বাহাদুর ফজলুর রহমান ফাউন্ডেশন, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জেলা সদর হাসপাতাল রোগী কল্যাণ পরিষদ,আইভিশন-২০২০ কমিটির সভাপতি তিনি।

এছাড়া, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচয় পৌষ সংক্রান্তির পিঠা উৎসব। শেরপুরের নারীদের একত্রিত করে " উজ্জয়িনী" নামের একটি নারী সমিতি গড়ে তোলেন। এই উজ্জয়িনী মহিলা সংগঠনের মাধ্যমে গত পাঁচ বছর ধরে শীত মওসুমে পিঠা উৎসব হয়ে আসছে। ওই সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন কাজ শুরু করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রায় ৫শ'নারী নকশীকাঁথা তৈরি করা শিখেছেন।বর্তমানে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তিনি উজ্জয়নীর মাধ্যমে চক্ষু শিবির করে অনেক গরীব রোগীর চোখের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। উজ্জয়নীর ব্যবস্থাপনায় ও শেরপুর রোটারী ক্লাব এবং ময়মনসিংহ বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের সহযোগিতায় প্রতি বছর নামমাত্র মুল্যে ছানি পড়া অনেক রোগীর চিকিৎসা ও চোখের অস্ত্রোপচার করা হয়। গত জুন মাসে শেরপুর কমিউনিটি অনকোলজি ফাউন্ডেশন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক ক্যান্সার রোগী ও আক্রান্ত ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে ক্যান্সারের প্রাথমিক সেবা পৌছানো সম্ভব না।কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্ট, ঢাকা চেষ্টা করছে এর পক্ষে জনমত তৈরী, নীতি নির্ধারকদের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরা এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলের মাধ্যমে ক্যান্সার সেবা দেওয়া।

ডালিয়া আপা তাঁর বাবার কবরের পাশে গড়ে তুলেছেন "হার্ট ফাউন্ডেশন " ছিন্নমুল শিশুদের জন্য করেছেন রাজিয়া সামাদ "শিশু ফাউন্ডেশন"।

সড়কের পাশে গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, শীতার্তদের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ,অসুস্থ দরিদ্র রোগীদের সেবা ও ওষুধ বিতরণ,দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা, নির্যাতিত নারীদের সহায়তা,বর্ন্যাতদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ,নওমুসলিমদের সহায়তা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দানসহ শহর পরিচ্ছন্নতা এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ রাত জেগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ী পাহারায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে চলেছেন।

রাজিয়া সামাদ ডালিয়া জানান, মানব সেবায় আসার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর খালা। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে ঢাকার জমি, রাজশাহীতে শ্বশুর বাড়ির জমি, শেরপুরে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ওয়ারিশের সম্পত্তি সবই গেছে। কিন্তু তাতে কোন আফসোস নেই তার।

তিনি বলেন, আমি হয়তো সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছি, সেটা করতে পেরেছি কি- না জানি না, তবে চেষ্টা করেছি। গভীর একটি জঙ্গলের সামনে ভোতা একটা দা হাতে নিয়ে সুগম পথ তৈরির জন্য এসেছিলাম। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এক সময় নিজের অর্থ সম্পদ ব্যয় করেই সব করেছি। কিন্তু এখন আমার কাজে প্রতিনিয়ত আমার ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু -বান্ধব শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রতিনিয়ত সহায়তা করে যাচ্ছেন। তবে কাজ করতে গেলে টাকা কোন সমস্যা না, সমস্যা মানসিকতার।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি এটাই আমার চিন্তা।

শেরপুর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাস্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া বলেন, এমন একজন মানব হিতৈষী ডালিয়া আপার সংস্পর্শে আসার সুযোগ হওয়ায় আমি মনে করি আমার জীবন সার্থক। তিনি একজন মানব দরদী সমাজ সেবক, নিরহংকার সত্যিকারের মানুষ। ডালিয়া আপা প্রকৃতপক্ষে একজন মহিয়সী নারী। তিনি তার সবকিছু অসহায় মানুষের জন্য উৎসর্গ করে চলেছেন।

রাজিয়া সামাদ ডালিয়া সম্পর্কে শেরপুর ডায়াবেটিস সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন ঠান্ডু বলেন,"ডালিয়া আপা আসলে একজন মহিয়সী নারী। তিনি তার সবকিছু সমাজের উন্নয়নের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি শেরপুরে এসেছেন, থাকছেন শুধুই মানুষের জন্যে।আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এমন মানুষ সমাজে বিরল।"

শেরপুর পৌরসভার তিন বারের সাবেক মেয়র গোলাম কিবরিয়া লিটন বলেন, "তিনি নারী সমাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছেন। তাঁকে দেখে অনেকেই মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন। তিনি সমাজের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।"

 

ভোরের আকাশ/মি