বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাভারের আশুলিয়ায় গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মাওলানা মো. সাদিকুর রহমান (২৮)নামে এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় পৃথক আরও চারটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।রাতে হওয়া এসব মামলায় মোট ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর সহস্রাধিক অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ আগস্ট) দিবাগত রাতে নিহতের স্ত্রী মোছা. শাহিদা আক্তার (২৩)বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় আটজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন।
নিহত মাওলানা মো. সাদিকুর রহমান (২৮) ময়মনসিংহের ধুবাউরা থানার কালিকাবাড়ি এলাকার মো. আ. লতিফের ছেলে। পরিবারসহ আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকায় কামাল উদ্দিনের বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। আশুলিয়ার পলাশবাড়ী স্কাইলাইন গার্মেন্টস কারখানায় দুই বছর ধরে পেশ ইমাম ছিলেন তিনি। মামলায় সাভার উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন খান (৫০), আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন ভূইয়া (৪৫), আশুলিয়া থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কবীর সরকার (৪৫), এনামুল হক মুন্সি (৪৭), মুঞ্জ দেওয়ান (৫৮), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৫), নুরুল আমিন সরকার (৪৫), মইনুল ইসলাম ভুঁইয়াসহ (৪২) অজ্ঞাত আরও ৩০০-৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে বাসা থেকে বাইপাইল কাঁচা বাজারে বাজার করতে যান সাদিকুর রহমান। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিনি জানতে পারেন, গুরুতর আহত হয়ে তিনি বাইপাইল বগাবাড়ি হ্যাপি জেনারেল হাসপাতালের সামনে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। পরে তাকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে বাদি জানতে পারেন, পেটে গুলি লেগে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ আগস্ট দুপুর ১টার দিকে তার মৃত্যু হয়। এতে আরও বলা হয়, বাদি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, আন্দোলন চলাকালে ১-৩ নম্বর আসামির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩০০-৪০০ নেতাকর্মী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ সেদিন ওই এলাকায় যাকে পাচ্ছিল তাকেই মারধর ও গুলি করছিল। এমন সময় সেখানে সাদিকুর রহমানকে তারা মারধর ও পেটে গুলি করে। এরই জেরে তার মৃত্যু হয়। এছাড়া আরাফাত মুন্সি (১৫) নামে এক শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় তার বাবা স্বপন মুন্সি (৩৬) বাদি হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে আশুলিয়া থানায় দশজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। নিহত আরাফাত মুন্সি (১৫) গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের ছোট বনগ্রাম এলাকার স্বপন মুন্সির ছেলে। পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার বাইপাইলের নামাবাজারের আব্বাস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকত সে।
আশুলিয়ার পলাশবাড়ী বার্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। মামলায় পাথালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ান (৬০), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৫), সোহাগ মেম্বার (৪০), সফি মেম্বার (৪৫), জুয়েল (২৮), মো. সোহাগ দেওয়ান (৩০), রাতুল (২৮), সুমন পন্ডিত (৩৯), রহিম বাদশা (৪৫), রনি মেম্বারসহ (৪৫) অজ্ঞাত আরও ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাসা থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে পলাশবাড়ী স্কাইলাইন গার্মেন্টস কারখানার সামনে নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের সামনে আসে সে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাদি জানতে পারেন, গুরুতর আহত হয়ে তার ছেলে স্কাইলাইন গার্মেন্টস কারখানার সামনে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছেন।
পরে তাকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে বাদি জানতে পারেন, পেটে গুলি লেগে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এতে আরও বলা হয়, বাদি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, আন্দোলন চলাকালে ১-৬ নম্বর আসামির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২০০-৩০০ নেতাকর্মী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ সেদিন ওই এলাকায় যাকে পাচ্ছিল তাকেই মারধর ও গুলি করছিল। এমন সময় সেখানে আরাফাত মুন্সিকেও তারা মারধর ও বুকে গুলি করে। এরই জেরে তার মৃত্যু হয়। এদিকে তানজিল মাহমুদ সুজয় (১৯) নামে এক শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে তার মামা মো. মাজেদুল হক (৩৬) বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। নিহত তানজিল মাহমুদ সুজয় (১৯) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বিটঘর এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার বাইপাইলের নামাবাজারের মালেক টাওয়ারের ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি গাজীপুরের টঙ্গীর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। মামলায় ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম (৫২), এনামুল হক মুন্সি (৪৭), মুঞ্জ দেওয়ান (৫৮), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৫), মইনুল ইসলাম ভুঁইয়া (৪২), সফি মেম্বার (৪৫), পান্নু শেখ (৩৫), গাউছ মোল্লা (৩৬), সুলতান (৪২), রিয়াজ (৪০), মাহবুব (৩৮), ফরহাদসহ (৪০) অজ্ঞাত আরও ৩০০-৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে বাসা থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে পলাশবাড়ী শাহরিয়ার গার্মেন্টস কারখানার সামনে নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের সামনে আসে সে। বিকেল সাড়ে আড়াইটার দিকে বাদি জানতে পারেন, গুরুতর আহত হয়ে তার ভাগ্নে শাহরিয়ার গার্মেন্টস কারখানার সামনে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। খোঁজাখুঁজি করে তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। তার পরিহিত প্যান্টের পকেটে থাকা কলেজের আইডি কার্ড থেকে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হন বাদি। এতে আরও বলা হয়, বাদি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, আন্দোলন চলাকালে ১-৬ নম্বর আসামির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩০০-৩৫০ নেতাকর্মী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ সেদিন ওই এলাকায় যাকে পাচ্ছিল তাকেই মারধর ও গুলি করছিল। এমন সময় সেখানে তানজিল মাহমুদ সুজয়কেও তারা মারধর ও গুলি করে। এরই জেরে তার মৃত্যু হয়। বিএনপিকর্মী মো. মামুন খন্দকার (৪৩) মৃত্যুর ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে নিহতের স্ত্রী মোসাম্মৎ সাথী (৩৬) বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
নিহত মো. মামুন খন্দকার (৪৩) আশুলিয়ার মধ্য গাজীরচট এলাকার মৃত হাজী মজিবর রহমানের ছেলে। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। মামলায় ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম (৫২), সুমন ভূইয়া (৫০), মো. কবির সরকার (৫২), এনামুল হক মুন্সি (৪৭), মইনুল ইসলাম ভুঁইয়া (৪২), মনিকা হাসান (৩০), মো. ফারুক হোসেন ওরফে ওমর ফারুক (৪৭), মতিউর রহমান (৬২), মো. ছবেদ আলী (৪৫), লতিফ মন্ডল (৬৫), হাসান মন্ডল (৩৮), গাউস মোল্লা (৩৫), পান্নু শেখ (৩৫), আনোয়ার হোসেন (৩৫), রুবের ভুঁইয়া (জামাই) (৩৫), মো. শাকিল হাওলাদার (৪৫), ইকবাল করিব আলম (৫৫), হাজী মিজানুর রহমান (৬০), আ. কাদের দেওয়ান (৬০), রোমেল (৪০), এ. আর মন্টু পাটোয়ারী (৫৫), মিরণ মিয়া (৪৫), আমির হোসেন জয় (৩২), মো. আবুল খায়ের (৫০), মো. মনির হোসেন (৪০), শামীম মন্ডল (৪০), সাইফুল ইসলাম রানা (৩৮), সফি মাদবর (৪৫), আলমগীর মন্ডল (৩৮), তাওহীদুল ইসলাম (২৭), জিন্নত ব্যাপারী (৪৯), মোজাম্মেল হোসেন (৫০), হুমায়ুন কবীর (৪৫)। আসামিরা সবাই আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট রাত ১০টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আরিফের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন বাদির বাসায় এসে তার স্বামী যাতে আন্দোলনে না যায়, এ বিষয়ে শাসিয়ে যায়। এরপর দিনই তার স্বামী গুলিবিদ্ধ হন।
এতে বাদি উল্লেখ করেছেন, আসামিরাসহ আরও কয়েকশ মিছিলকারী অস্ত্রধারী তার স্বামীকে গুলি করে সড়কে ফেলে রাখে। দুপুর পৌনে ১টার দিকে বাদির ভাই মুঠোফোনে জানতে পারেন, মামুনকে গুলি করে ফেলে রাখা হয়েছে। উদ্ধার করে তাকে প্রথমে আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক ও পরে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেলে নেওয়া হয়। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে গণস্বাস্থ্য থেকে ঢাকার নিউরো সায়েন্স মেডিকেলে নেওয়ার সময় তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স মহাসড়কে আটকে দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। বাধ্য হয়ে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ আগস্ট চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এজাহারে আরও বলা হয়, বাদি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার স্বামীকে কপালে গুলি করেন। তাদের ৫০০-৬০০ জনের মিছিলে অন্তত ২০-২৫ জনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, ‘‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্ত করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ভোরের আকাশ/মি