logo
আপডেট : ২৫ আগস্ট, ২০২৪ ১১:৩৫
আকস্মিক বন্যার যত কারণ
আশীষ কুমার দে

আকস্মিক বন্যার যত কারণ

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হচ্ছে। কোনো কোনো বছর একাধিকবারও হচ্ছে। প্রতিবারই আকস্মিকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে এর ভয়াবহ রূপ। এ নিয়ে পরস্পর দোষারোপের রাজনীতিও চলছে। সম্প্রতি কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ ১২ জেলায় আকস্মিক প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর দোষারোপের এই প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বন্যা সামাল দিতে সেখানকার একটি ড্যাম খুলে দিয়ে পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের একাংশে প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে, এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে ভারত।

টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ ১২টি জেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙনস্থল দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় একের পর এক জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। এ নিয়ে ভারতকেই সরাসরি দায়ী করছে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল; যার মধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞও আছেন। এমনকি অন্তরর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও একই অভিযোগ করেছেন।

তবে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালীসহ ১২ জেলায় আকস্মিক প্রলয়ঙ্করী বন্যার কারণ নিয়ে খোদ বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। পরিবেশ, জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার পেছনে ভারত বাঁধের গেট খুলে দেওয়া অন্যতম কারণ হলেও এটি মূল কারণ নয়। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢল ও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারী বর্ষণে নদীগুলোর পানি বিপদসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলও বন্যার কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ভারত বন্যায় আক্রান্ত হলেই বাঁধের গেট খুলে দেয়। এ বছরও তারা কোথাও কোথাও গেট খুলে দিয়েছে এবং কিছু জায়গায় অতিরিক্ত পানির কারণে বাঁধের গেটগুলো ভেঙে গেছে।

শীর্ষস্থানীয় পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, গোমতীর ‘মহারানী’ ও মুহুরীর ‘কলসি’ দুটোই ওয়াটার কন্ট্রোল স্ট্রাকচার (পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো); পানি সরানোর ব্যারাজ (জলাধার) নয়। কিন্তু ফেনীসহ ওই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার জন্য আন্ত:সীমান্ত নদী গোমতী ও মুহুরীর বাঁধ খুলে বাংলাদেশকে প্লাবিত করার জন্য সরাসরি একতরফাভাবে ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকদিন আগে সুস্পষ্ট লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছিল। লঘুচাপের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক ভারী বর্ষণ হয়েছে, অন্যদিকে উষ্ণ, মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণে অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম ছিল। এমনটা সাধারণত ঘটে না। এবারের বন্যার এটিও একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এই আবহাওয়াবিদ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়ার ভাষ্য মতে, বাংলাদেশের উজানের অংশে বিশেষ করে ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে প্রচুর ভারি বর্ষণের কারণে পানি নেমে আসায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় হঠাৎ বন্যা হয়েছে। অতি বৃষ্টিপাতের কারণে নদীগুলোর পানি বিপদসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন এলাকাও বন্যার কবলে পড়েছে। ভারত বন্যায় আক্রান্ত হলে সাধারণত বাঁধের গেট খুলে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, তা না হলে অতিরিক্ত পানির কারণে বাঁধের গেটগুলো ভেঙে যেতে পারে। এ কারণে তাদের ওখানে বেশি বৃষ্টিপাত হলে তারা বাঁধের গেট খুলে দিতে বাধ্য হয়।

প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘উজানের পানি পাহাড় থেকে নেমেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই আমরা যদি কোনো বড় জলাধার করতে পারি, তা হলে পানি সরাসরি আঘাত না করে জলাধারে পড়লে আমাদের ক্ষতি কম হবে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করলে তারা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার আগে যদি জানিয়ে দেয়, তাহলে আমরা সতর্ক হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবো। না জানিয়ে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিলে মুশকিল হয়।’

পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, সিলেট অঞ্চলের নদীতে উজান থেকে প্রচুর বালি ও পাথর আসে। তাই ড্রেজিং করার কয়েকদিন পরই নদীগুলো ফের ভরাট হয়ে যায়। এ কারণে উজানের ঢল এলে সিলেট অঞ্চলে বন্যা হয়। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

‘ত্রিপুরার ডম্বুর ড্যামের কারণে ফেনীতে বন্যা’ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘ডম্বুর ড্যামের পানি ফেনীতে যায় না। ফেনীতে যায় মুহুরীর জল। ড্যাম জলাধার তৈরি করে, ব্যারেজ পানি সরিয়ে নেয়। তাই গোমতির ‘মহারানী’ ও মুহুরীর ‘কলসি’ ব্যারেজ বা ড্যাম নয়, পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। আমি আবারো বলছি, কলসি ড্যাম ছাড়ার কারণেও বন্যা হয়নি। ডমরুর’র তুলনায় এর জলাধার এক দশমাংশ। সুতরাং অতিবৃষ্টিতে বন্যা হয়েছে।

নদ-নদী নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ^াস বলেন, প্রতি বছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে এসে আন্ত:সীমান্ত নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশের তলদেশ ভরাট করে ফেলে। এতে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ফলে এসব নদীতে বেশি পানি এলে তা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। নদীর নাব্যসংকট, হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সøুইস গেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, হাওর-বাওড়, খাল-বিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটার কারণে প্রায় প্রতি বছরই সিলেট অঞ্চলে বন্যা হয়।

নদী গবেষক শেখ রোকন গণমাধ্যমকে বলেন, অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে। যেমন-ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে। আবার আত্রাই বা পুনর্ভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি, যাতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতি বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম এবং ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দপ্তরও সেটি দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটিই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।

তবে ভারতের ত্রিপুরার গণমাধ্যমগুলো বলছে, ত্রিপুরা রাজ্যজুড়েই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় সেখানে চারদিকে ২৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে সেখানকার বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে ভারত। ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতীর জেলা প্রশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা তার সরকারি এক্স অ্যাকাউন্টে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।

এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক লিখিত বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘ত্রিপুরা এবং পাশের এলাকায় অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা হয়েছে। বাংলাদেশের তরফে অভিযোগ উঠছে, ত্রিপুরার ডমরুর বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ায় সে দেশের (বাংলাদেশ) বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এটি তথ্যগত ভুল। ডমরুর বাঁধ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। সেই বাঁধের উচ্চতা মাত্র ৩০ মিটার, সেখানে যে পানি জমা হয়, সেটি বাংলাদেশে বন্যার কারণ হতে পারে না।’ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অনেকগুলো আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দুই দেশের লোকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে, অযথা দোষারোপ করার প্রয়োজন নেই।’

তবে যেকোনো যৌথ নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে জানানোর রীতি রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, হাইড্রোপাওয়ারে গেট থাকে না; যেটি খুলে দিতে হবে। এটি ‘স্পিল’ করেছে। ভারতের অংশের লেক পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলে অটো স্পিল করে। ভারতের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা সত্য। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। এটি খুব ছোট হাইড্রোপাওয়ার, গোমতী নদীর ১২৩ কিলোমিটার উজানে এ হাইড্রোপাওয়ার। হঠাৎ টানা বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়েছে। তিন দিন আগে ভারতের যে পূর্বাভাস, তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, গোমতী নদীতে একটা স্টেশনের (অমরপুর) পানির লেবেলের তথ্য ভারত দিয়েছে।

তিনটি কারণে ফেনীর বন্যা হয়েছে জানিয়ে ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, আগে থেকেই সেখানে নদীতে পানির লেবেল অনেক বেশি ছিল। তারপরে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে; যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জেলার পরশুরামে হয়েছে ৩১৩ মিলিলিটার বৃষ্টি। আর সীমান্তের ওই পাশে রেকর্ড পরিমাণ ৩২৪ মিলিলিটার বৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, নিম্নচাপের কারণে সমুদ্র ফুলেফেঁপে উঠেছে। নিম্নচাপের কারণে সমুদ্রের লেবেলের উচ্চতা বেড়ে গেলে উজানের পানি সমুদ্রের দিকে ঠিকমতো নামে না। এ তিনটি কারণে ফেনী অঞ্চলে বন্যা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি