logo
আপডেট : ২৫ আগস্ট, ২০২৪ ১৫:১৫
গরিবের বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অনেক প্রত্যাশা
মোস্তাফিজ বুলবুল

গরিবের বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অনেক প্রত্যাশা

উঁচু সিঁড়িতে উঠার স্বপ্ন দেখা মানুষ কখনো পশ্চাৎপদ হন না, শত সংকুলতা প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করে সততা, নিষ্ঠা উদারতার বিনিময়ে উঁচু সিঁড়ির লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যান সেই স্বপ্ন দ্রষ্টা। গরিবের বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বাস্তব দৃষ্টান্ত। বিগত সরকার এই মানুষটিকে শুধু হেনস্তাই করে ক্ষান্ত হয়নি ১৬৮টি মামলা দিয়ে জেলহাজতে নিক্ষেপ করার চেষ্টারও কমতি ছিল বলেও মনে হয় না। কিন্তু তাতেও তিনি দুমড়ে ও মোচড়ে যাননি বলে অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট হয়ে উঠে। বরং তিনি সব আঘাত সহ্য করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সেইসব ষড়যন্ত্র প্রত্যক্ষ করে আসছিলেন বলেই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে সেই ষড়যন্ত্র তছনছ করে দিয়ে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূকে।

এতে শুধু তার মুখেই হাসি ফুটেছে বলে আমরা মনে করি না, হাসি ফুটেছে পুরো বাংলাদেশের নিপীড়িত নিষ্পেষিত মানুষের মুখে। হাসছে বাধংলাদেশ। তার নেতৃত্বে নতুন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন এদেশের মানুষ। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণে সফল হবেন। তিনি পারবেন নতুন বাংলাদেশ গড়তে সেই আত্মবিশ্বাস আমাদেরও রয়েছে। আশাকরি বিশ্ববাসী তাকে সেই সুযোগ করে দিবেন। এক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এদেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিবেন সেই বিশ্বাসও আমাদের রয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ছাত্র জনতার গণআন্দোলন তাকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে আসীন করে তার লালিত স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছে। তাকে মামলা হামলা, জেল জুলুম থেকে রক্ষা করে যোগ্য আসনে বসিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে গতি সৃষ্টি করেছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের মানুষ তিনি। অথচ বিশ্ববরেণ্য এই চিন্তাবিদ, সমাজসেবক, অর্থনীতিবিদ রাজনীতির দাবার চালে নিজ জন্মস্থান বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। বিশ্ববাসী যাকে নিয়ে গর্ববোধ করে সেই মানুষটি নিজের দেশে ছিলেন অবহেলিত ও অবজ্ঞার শিকার। অথচ এই খ্যাতিমান ব্যক্তিটি বিগত সরকারের আমলে নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশে আসারই সুযোগ থেকে ছিল বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, মামলা ও হামলার ভয়ে ছিল তটস্ত। আজ তিনি বাংলাদেশের কর্ণধার। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুরো বাংলাদেশ। পুরো বিশ্ব জুড়ে বেড়েছে তার সম্মান ও খ্যাতি। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার। আর সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ছাত্র জনতা। এজন্যে আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র জনতাকে জানাই লাল গোলাপ সালাম। এদেশের প্রতিটি ক্লান্তিকালে ছাত্ররাই পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বার বার বহন করছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাত্র এক মাসের আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে নিপিড়ীত ও নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন ছাত্র সমাজ। আগামীতে এদেশটিতে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হবে সরকার সেই প্রত্যাশাই আমাদের রইলো।

মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিণী ড. আফরোজী ইউনূস। ব্যক্তিগত জীবনে মুহাম্মদ ইউনূস দুই কন্যার পিতা। মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ছোট ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব।

তার প্রথম বিদ্যালয় মহাজন ফকিরের স্কুল। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। কলেজে তিনি নাটকে অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা এবং আজাদী পত্রিকায় কলাম লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বয়েজ স্কাউটস এ যোগ দেন এবং বয়েজ স্কাউটসের পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স -এ গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময় ড. ইউনূস দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অসচ্ছল বাংলাদেশিদের মধ্যে ঋণ বিতরণের জন্য তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসচ্ছলদের রক্ষায় অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমন কি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। ড. ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৮টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক। বাংলাদেশে যেখানে শক্ত সামর্থ্য জামানত রেখেও ব্যাংকের ঋণ খেলাপির তালিকা কমানো যায় না সেখানে জামানত ছাড়াই ভূমিহীনদের যে ঋণ দেওয়া যায় তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। এই নিঃস্ব ভূমিহীন পিছিয়ে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে যে ব্যাংক ঋণের আওতায় আনা যায় এবং তাদের জীবনের অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দেওয়া যায়, এই ধারণার প্রবর্তন করেন তিনি। ড. ইউনূস ভূমিহীনদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ধারণা লালন করেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এই ঋণ প্রকল্প চালু করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে রূপ লাভ করে।

বর্তমান বিশ্ব প্রজন্মের আইকন হলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, নোবেল জয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তার নামে সরকারি অর্থে বানানো কর্নার বা সেন্টারের মত নয়, সারা পৃথিবীর ১০৭টি ইউনিভার্সিটিতে ‘ইউনূস সেন্টার’ আছে। ইউনিভার্সিটিগুলো নিজেদের উদ্যোগে এই সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে তার মাইক্রো ফাইন্যান্স। যেটা তাকে এবং তার গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দিয়েছিল। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভূষিত হয়েছেন আমেরিকার প্রসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ডে, পেয়েছেন মার্কিন কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ড। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানের এই তিনটি পুরস্কারে যারা পুরস্কৃত হন তাদের আর দুনিয়ার কাছে কিছু চাওয়ার থাকে না। এছাড়াও ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে অজস্র পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে তিনি। তাঁকে সম্মানিত করতে পেরে পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানই নিজেদের ধন্য মনে করেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বের জীবিত লিডিং ইন্টালেকচুয়ালের যেকোন তালিকাতে প্রথম তিন জনের মধ্যে তিনি একজন। অনেকের মতে তার অবস্থান ১ নম্বরে।

বাংলাদেশের গণমানুষের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অনেক প্রত্যাশা। তিনি সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন করে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষকে সম্মানিত স্থানে বসানোর সুযোগ করে দিবেন বলে আমরা আশাবাদী। বিশ্বর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবেন। এদেশের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করবেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনবেন। সকল স্তরে বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগ নিবেন। দেশে লুটপাট ও টাকা পাচার বন্ধসহ দুর্নীতি ও দু:শাসন বন্ধ করবেন। উন্নয়ন কাজে গতি আনবেন। বিগ সরকারের অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করবেন।

সর্বোপরি দেশে যাতে সৎ, সাহসী, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান অদম্য মনোবলের রাজনীতিক সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেই ব্যবস্থা করবেন বলে আমরা আশাবাদী। তবেই দেশের মানুষের মুখে ফুটবে সুখের হাসি। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সেই প্রত্যাশা ও দাবিই আমাদের।

ভোরের আকাশ/ সু