সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুভ পরিণতিতে দেশে নতুন পরিস্থিতি এক অনিবার্য বাস্তবতা। শুধু কি কোটা সংস্কার? সব ধরনের অনাকাক্ষিত, জননিন্দিত বহু অপসংস্কারের নতুন মাত্রা দেওয়া উদ্ভূত পরিবেশের সময়োচিত সমাধান। দেশ গঠনের নতুন প্রক্রিয়ায় সাবেকি আমলের হরেক বিপন্নতাও সামনে চলে আসছে। সেখানে নিত্য জীবনযাপনের নানা দুঃসময়ও বর্তমান পরিস্থিতির অনুষঙ্গ হচ্ছে।
মানুষের জীবনধারণের প্রধান ও সর্বোত্তম নিয়ামক শক্তি তার প্রতিদিনের আহারের হরেক আয়োজন। সবার আগে প্রত্যেকের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা আবশ্যকীয়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে এলেও হরেক বিপর্যয় পিছু ছাড়ছে না। সেখানে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া প্রতিবেশ জনগণের এক অস্থিরতার নিত্য দোলাচল। আর যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে সবার আগে চাপ পড়ে মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদার ওপর। খাদ্যপণ্যই এখানে অনেকটা এগিয়ে থাকে।
নতুন বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ার কিছু সময় আগেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সার্বিক জনগণের দিশাহারা অবস্থাও দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। সেখানে শুধু যে নিম্নবিত্তরা অসহায়ভাবে দিন পার করেছেন তা কিন্তু নয়। মধ্য ও উচ্চবিত্তরাও হিসাব-নিকাশের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেননি। যে কোনো কারণে পরিস্থিতি বেসামাল হলে তার প্রথম চাপটা গিয়ে পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ওপর। এটি নতুন কোনো পরিস্থিতি নয়।
সামনে বরাবরই আসে এক অসহনীয় দখলদারিত্বে বাজার সিন্ডিকেট, যারা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। তবে কোনোভাবেই অজানা-অচেনা বিস্ময় নয়। চিরচেনা সংগঠনটি তার প্রবল দাপটে যে মাত্রায় বাজারদরের ওপর নগ্ন থাবা বসায় তা কেমন করে নিয়ন্ত্রণহীন হয় সেটাও ভাবিয়ে তোলার এক অহেতুক ব্যবস্থাপনা। পেঁয়াজ কতভাবে সাধারণ থেকে বিত্তশালীদের নাজেহাল করেছে সেটা আড়াল করার প্রয়োজনই দেখা যায়নি। যখন সচরাচর বাজারে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না তখন দাম বাড়লে সেগুলো আবার বেরিয়ে আসছে, আড়ালে থাকছে না। সত্যিই এক ভূতুড়ে তুলকালাম দুরবস্থা। পেঁয়াজ নিয়েও কত হিসাব-নিকাশ কুচক্রী ব্যবসায়ীদের। সত্যিই যেন অহেতুক দাবানল।
বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারই নয় বরং পুরোদমে বদলে যাওয়া অন্যরকম এক বাংলাদেশ সবাইকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করে যাচ্ছে। পুরনো সময়ের হরেক জঞ্জাল নতুন যাত্রাপথে যেভাবে পিছু হটছে সেখানে জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষা বাসা বাধতে দেরি হচ্ছে না। আর আধুনিক প্রজন্মের ছাত্রসমাজ সময়ের দাবিতে যে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিলেন সেখানে আশা জাগানিয়া অনুভবে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতাকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বাজার সিন্ডিকেট বিলুপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। তবে ধারণা করতে অসুবিধা নেই নানামাত্রিক অপসংস্কারের সঙ্গে সিন্ডিকেট নামক দুর্বৃত্তায়নও কি কিছুটা অন্তত পিছু হটবে? তেমন জবাবের জন্য আমাদের অতি অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। একটা পণ্যের বাড়লে প্রতিযোগিতায় আরও পণ্য সামনের সারিতে চলে আসে। সেখানে পচনশীল দ্রব্য মাছ, মাংস, সবজির বাজার যেভাবে মাত্রা ছাড়ায় তাও এক চরম বিপত্তিকর দুরবস্থা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধারা ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে সময় বেঁধে দিয়েছে। সেটা কেবলমাত্র সাতদিনের মধ্যে।
কতখানি ফলপ্রসূ হবে তাও অপেক্ষার পালা। বাজার সিন্ডিকেটের কোথায় যে এক অবধারিত সুরক্ষার বলয়, যেখানে কেউই প্রবেশের সুযোগটিও পায় না। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সরেজমিনে হাজির হয়ে তদারকিতে নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করেছে। সেটাও কম বড় দায়িত্ব নয় কিন্তু। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা পড়াশোনায় নিজেদের নিয়োজিত করে তাদের সাংসারিক কিংবা পারিবারিক দায়িত্ববোধ সেভাবে জেগেও ওঠে না। ক্রমান্বয়ে সব কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের অভ্যাসও হয়ে যায়।
সেখানেও ছাত্রদের কাছে বাজার ব্যবসায়ীদের নাজেহাল অবস্থা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৩ দপ্তর ও সংস্থাকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সাতদিনের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতায় জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পরিস্থিতি যদি বেসামাল হয় তার দায় বর্তাবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ওপর। বহু অন্যায়-অনিয়মের শিকার হয়ে সাধারণ মানুষ এতদিন জগদ্দল পাথরের মতো শক্ত হয়ে কোনোমতে টিকে ছিল। কিন্তু আর নয়। অসময়ে বহু অত্যাচার-নিপীড়নে মানুষকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে নতুন আলোয় নবোদ্দীপনায় সময়ের স্রোতে অবগাহন করা পরিস্থিতিকে মান্যতা দেওয়া। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বাজার সিন্ডিকেটের হরেক পীড়ন আর দুর্বৃত্তায়নের দিন অবলুপ্তির গহ্বরে। আধুনিক সময় ও চাহিদাকে যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য করে নবোদ্দীপনায় সামনে এগিয়ে চলাই হবে নতুন অন্য এক বাংলাদেশ, যা সমতার আবরণে কোনো বৈষম্যকেই মাথা তুলতে দেবে না।
ভোজ্যতেল থেকে নিত্যপণ্য চাল, চিনি সবই যেন এক সূতোয় গাঁথা মালা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। আলোচনায় উঠে আসে লাগামহীন নিত্যপণ্যকে কিভাবে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে। কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। ঝুঁকিপূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা হঠাৎ করে কিভাবে যে মোড় পরিবর্তন করে জানা-বোঝার অতীত। নির্বিকারে, অবলীলায় যেভাবে সাধারণ ভোক্তা শ্রেণির ওপর চড়াও হয় তাও মুনাফা আদায়ের চরম অদৃশ্য দুর্বিপাক। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় যে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেখানে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়াও পরম অঙ্গীকার। কোনো খাত সংস্কার থেকে বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত হলে কর্মসূচির অভ্যন্তরে ঘাটতি, ত্রুটি থাকা অসম্ভব কিছু নয়, যা পরবর্তী সময়ে বাজার সিন্ডিকেটকে আরও জোরদার করে পরিস্থিতিকে বিপন্ন করতে পারে। সর্বক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের যে তীক্ষè পর্যবেক্ষণ এবং নজরদারি সেটা সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াও এক প্রকার সচেতন দায়বদ্ধতা। কারণ বনেরা বনে সুন্দর/শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। আর তাই অগণিত শিক্ষার্থীর যথার্থ ভূমিকা অতি অবশ্যই তার পাঠাভ্যাসে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত পাঠদান কর্মসূচিতে ফিরতে হবে। আরও যোগ্য নাগরিক হয়ে পাঠক্রম শেষ করে দেশের জন্য নতুন সময় ও কর্মকে অধিভুক্ত করতে আধুনিকতার অনুষঙ্গ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে ভোক্তা অধিদপ্তর অনেক ক্ষেত্রেই হতাশ। তারা বলছে যেখানেই নজর দেওয়া হচ্ছে সবখানেই অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার। সুষ্ঠু স্বাভাবিক প্রাতিষ্ঠানিক বলয় ফেরাতে আরও সময়ের প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা অবৈধ সিন্ডিকেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তাদের দরকারি সনদপত্র ও পরিচয় সবার সামনে আনার দাবি জানান। কারণ বাজার সিন্ডিকেটও চিহ্নিত করা জরুরি। তারা কি শুধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট? নাকি আড়ালে রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী? সব জায়গায় যারা মুনাফা কুক্ষিগত করতে মরিয়া। কঠোর নজরদারিতে পুরনো সব জঞ্জাল সরাতে ব্যর্থ হলে যে আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয় তা আসতে সময়ক্ষেপণ হতে পারে বলে সংস্কার আন্দোলনকারীদের আশঙ্কা। তবে ভোক্তা অধিদপ্তর এসব অনিয়ম, বিশৃঙ্খলায় কোটা সংস্কারকদের পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করছেন। এতদিন চেষ্টা করেও যা তারা পারেননি এবার সম্মিলিত উদ্যোগে নতুন সময়কে কাজে লাগানোই হবে কঠিন অঙ্গীকার ও প্রত্যয়।
বাজার সিন্ডিকেটের বিপরীত কর্মযোগে কত খাদ্যপণ্যের নয়ছয় হয়েছে সেটাও ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। পচনশীল পণ্য বস্তাপচা পেঁয়াজ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতেও দেখা গেছে। তাই প্রভাবশালী সংস্কার আন্দোলনের নতুন প্রজন্মের কাছেই রয়েছে যথাযথ সমাধান এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ সংগ্রাম।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার আগামীর যাত্রাপথে সাধারণ মানুষের প্রতি পরম দায়বদ্ধতায় হরেক অপসংস্কারকে পিছু হঠানোই উদীয়মান প্রজন্মের দৃঢ় প্রত্যয়। তেমন অঙ্গীকারে সর্বক্ষেত্রে হাত দিয়ে নিজেদের শিক্ষাজীবনের মূল্যবান সময় অপচয় যেন বেশিদিন স্থায়ী না হয়। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বাড়ার গতি-প্রকৃতি চিরায়ত এক অপসংস্কার। সেখানে ভোক্তা থেকে আরম্ভ করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর জোর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে খাদ্যপণ্যকে স্থিতিশীল ও সহনীয় রাখতে সর্বসাধারণের দায়বদ্ধতা, নজরদারি, সচেতনতাও জরুরি। দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা আর কখনো পূর্বের দামে ফিরে আসে না। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। তবে তীক্ষè দৃষ্টি দেওয়া অনিবার্য, যাতে মূল্যটা আর কখনো বাড়তে না পারে। অকারণে-অপ্রয়োজনে ভোক্তা শ্রেণিকে বিপর্যস্ত করে দরকারি পণ্যকে লাগামহীন করতে না দেওয়া থেকে ব্যবসায়ীদেরও সচেতন দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে।
বাংলাদেশ হরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। নানা প্রতিকূল পরিবেশকে সামাল দিয়ে আমাদের টিকে থাকতে হয়। সেখানে আবার যদি অন্যরকম লীলাখেলায় জনগণকে বিব্রত, বিপন্ন দুরবস্থায় নিপতিত হতে হয় সেটা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত এবং মঙ্গলজনক নয়। অন্যায়-অবিচার আর অনাচারের পালাক্রম এবার যেন তার অন্তিম সময়কে পার করে নবপ্রভাতের নতুন সূর্যালোকের রক্তিম আভায় রাঙিয়ে দিতে পারে। তেমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই শুধু নয় নিরাপদ, নির্বিঘ্ন বাংলাদেশও আমাদের আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা বাংলাদেশের অগণিত মানুষ মাছে-ভাতে বাঙালির চিরন্তন প্রবাদে যেন খেয়ে-পরে, সুখে-শান্তিতে সামনের দিনগুলো কাটাতে পারে- তেমন প্রত্যাশা থাকল।
লেখক : সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/ সু