বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশের জেলাগুলো বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী। এছাড়া চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতেও বন্যা দেখা দিয়েছে। এক কথায় যদি বলি, পুরোটাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক কারণে বন্যা বলার মূল কারণ হলো, বাংলাদেশে যে বৃষ্টি হয় এবং হচ্ছে তা কিন্তু ভারতেও হয়েছে। ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ এসব অঞ্চলে যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণের দিকে তাকানো হয় তাহলে দেখা যাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিলিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। একদিন হয়ে যদি থেমে যেত তাহলেও হয়তো এ রকমটা হতো না। কিন্তু টানা দু-তিনদিন অব্যাহত থাকায় এ রকমটা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে এসেছে।
বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির মোটাদাগে কারণ তিনটি। এক. ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল, দুই. উভয় দেশে অতিবৃষ্টি এবং তিন. একই সময়ে সমুদ্র ফুলে ওঠা অর্থাৎ জোয়ার। এতে যা হচ্ছে, বৃষ্টির পানি বঙ্গোপসাগরে নামতে পারছে না। সমুদ্র ফুলে ওঠায় অঞ্চলগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এ তিন কারণে অভূতপূর্ব এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠছে এটা মানবসৃষ্ট কিনা। এর পক্ষে আসলে একটা পয়েন্ট আছে মাত্র। ভারতের গোমতী জেলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে একটা বাঁধ আছে, দুম্বুর বাঁধ। এ বাঁধের সক্ষমতা বেশি নয়, ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে তার। ছোট বাঁধ হওয়ায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হলে তা আটকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অতিবৃষ্টির কারণে উজানে প্রচুর পানি জমা হচ্ছে, ধারণক্ষমতার বেশি রিজার্ভ হলে গেট খুলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কয়েক দিনে পানি উজান থেকে আসতে থাকায় গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, যা একদমই স্বাভাবিক নিয়ম। এমনকি আমাদের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও পানির স্তর বেড়ে গেলে খুলে দেওয়া লাগতে পারে। এর আগেও কখনো কখনো খুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন ব্যারাজেও দেখবেন সব গেট খোলা আছে। ফারাক্কাতেও খোলা রয়েছে। তিস্তা ব্যারাজেও খোলা। অনেক সময় রাস্তা কেটে দিয়েও পানি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটা বিবৃতি দিয়েছে যে, তাদের গোমতী নদী দিয়ে বাংলাদেশে যে পানি আসে দুম্বুর বাঁধের একটা গেট খুলে দিতে হয়েছে। মোট দুটি গেট। এই গেট খুলে দেওয়ায় এত বড় বন্যা হয়েছে তাও নয়। কারণ ওটা গোমতী নদীর ওপরে ছোট একটি বাঁধ। খোয়াই, মনুসহ সীমান্তবর্তী অনেক নদী দিয়ে পানি কর্ণফুলী, হালদায় আসছে। অনেকে না বুঝেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় বলছেন যে ভারত পানি ছেড়ে দিয়েছে। এজন্য মূলত ডুবে যাচ্ছে যা আসলে ঠিক নয়। প্রয়োজনে বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। তা যদি না করে তাহলে তাদের বাঁধের যে নিরাপদ বেষ্টনী আছে তা ভেঙে যাবে। আর তা ভেঙে গেলে পুরো এলাকায় ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। ভারতের সামনে এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
এর আগে গত জুনে বন্যার পেছনে মেঘালয়ের বৃষ্টির একটা ভূমিকা ছিল। এর ফলে সুরমা, কুশিয়ারা প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। এখন ত্রিপুরা, একই সঙ্গে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিপৎসীমার দুই মিটারের ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে যা অনেকেই বলছেন যে আগে কখনো দেখেননি।
ভারতের ত্রিপুরা মূলত একটি পাহাড়ি অঞ্চল। বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢল আকারে নীচে নেমে আসে। এখনো পূর্বাভাস আছে বৃষ্টির। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে বন্যার প্রকোপ আরো বাড়ে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদেরকে পুনর্বাসন করা। লোকজনকে উদ্ধার করার পর তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও সেবা দেওয়া এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ। এজন্য প্রয়োজনে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নিতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে, ভাঙার উপক্রম হয়েছে। এরই মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনসহ কোস্টগার্ড উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। শুকনা খাবার, স্যালাইন এসব প্রশাসনিকভাবে দিতে হবে। স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দিতে হবে। সঠিকভাবে উদ্ধারকাজ না চালালে অনেকেই মারা যেতে পারে। বন্যায় অনেক শিশু, নারী ও বয়স্করা ঝুঁকিতে আছেন। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। বন্যা কেন হলো তার কার্যকারণ অনুসন্ধানের সময় এখন নয়। এখন উদ্ধার তৎপরতা ঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। পরের ২৪-৪৮ ঘণ্টা কী হবে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো। আশা করা যায়, তারা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এরই মধ্যে নিয়েছেও। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রয়েছে। তাদের সবসময়ই একটা প্রস্তুতি থাকে। এবার যে অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে, বন্যা দেখা দিয়েছে এটার রেকর্ড খুব কম। সাধারণত সিলেট অঞ্চল, কুড়িগ্রাম, উত্তরাঞ্চলে তিস্তার পানি থেকে বন্যা হয়। ওই অঞ্চলগুলোয় সাধারণত এ রকম বন্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছিল। গঙ্গার পানিতে হয়তো ঢাকা বিভাগের মধ্যাঞ্চল বন্যাপ্রবণ বেশি।
এবার যে ভারী বৃষ্টিপাত হলো তা অনেক আগে থেকে পাওয়া যায়নি। যদি দুই সপ্তাহ আগে থেকে জানা যেত, অন্তত এক সপ্তাহ আগেও যদি জানা যেত যে অতিবৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বন্যা হতে পারে তখন সাতদিনের মধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড মোটামুটি ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাস দিতে পারে। ত্রিপুরায় পানির যে স্তর আছে কুমিল্লায় তা আসতে তো সময় লাগবে। তবে বন্যার ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেওয়াটা খুবই কঠিন। দেখলাম কিছু এলাকায় প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত। আটটি জেলার ৪৩টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। স্থানীয় রিসোর্স ব্যবহার করে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বেশ কঠিন। অন্যান্য এলাকা থেকে রিসোর্স নিয়ে কাজ এগোতে হবে। সারা দেশে তো আর বন্যা হয়নি। অন্যান্য এলাকা থেকে রিসোর্স নিয়ে এসে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
স্থানীয় অনেকেই বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় এ রকম পানি কখনই দেখেননি। তাদের ঘরের মধ্যে, উঠানে কোমর পানি। বিষয়টি মাথায় রেখে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। বন্যা পরিস্থিতি আমরা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ঘর উঁচু করা, আশ্রয় কেন্দ্র ঠিক রাখা, স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখার মতো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পানি অন্যদিকে ডাইভার্ট করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ নদীগুলো বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। পানি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই ডাইভার্ট হয়। নদীগুলো আবার একটি অন্যটির সঙ্গে সংযুক্ত। মনু নদী থেকে কুশিয়ারায় যাচ্ছে। কুশিয়ারা থেকে যাচ্ছে মেঘনার নিম্ন অববাহিকায়। চাঁদপুরে এসে লোয়ার মেঘনায় পড়ছে। প্রাকৃতিকভাবেই ডাইভারশন হয়। ত্রিপুরার পানি কুমিল্লা থেকে শুরু করে ফেনী, খাগড়াছড়ি পর্যন্ত অনেকগুলো চ্যানেল আছে যেগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়। এভাবে ত্রিপুরার পানি বাংলাদেশে ঢোকে। কিন্তু টেকনিক্যালি ডাইভার্ট করা কঠিন। বরং পানি নামিয়ে দিতে হবে। বর্তমান বন্যা থেকে ঠিক করা যেতে পারে কোথায় কোথায় বাঁধ করতে হবে, কোথায় বাড়িঘর উঁচু করতে হবে অথবা কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে বন্যাকে মোকাবিলার জন্য। এ অভিজ্ঞতা থেকে আরো গবেষণার সুযোগ আছে।
লেখক : অধ্যাপক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট
ভোরের আকাশ/মি