ভারি বর্ষণ না হলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এদিকে ত্রিপুরাসহ ভারতের ৯ রাজ্যে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কায় ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি)। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসেও লঘুচাপের কারণে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল সোমবার বন্যা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে জানান, দেশে এক সপ্তাহ ধরে যে ভয়াবহ বন্যা চলছে, তাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ জন। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ জনে।
অল্প সময়ের মধ্যে তা বিস্তৃত হয় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে। এই ১১ জেলায় ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জানিয়ে কামরুল হাসান জানান, বন্যায় মৃত ২৩ জনের মধ্যে কুমিল্লায় মারা গেছে ছয়জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে মারা গেছে পাঁচজন করে এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। আর একজন করে মারা গেছে ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে।
সচিব কামরুল হাসান বলেন, পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তিন হাজার ৮৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন মানুষ এবং ২৮ হাজার ৯০৭টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৪৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির দাবি পাউবোর : চলমান বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত ফেনীসহ বেশিরভাগ স্থানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। গতকাল সোমবার সকালে কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের ভেতরে তেমন বৃষ্টি হয়নি। সেই সঙ্গে উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত আছে। ফলে ফেনী ও কুমিল্লার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় ফেনীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, তবে কোনো কোনো স্থানে পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে।
ফারাক্কার ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত : ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। আজ সোমবার গেট খুলে দেওয়া হয়। এতে একদিনে বাংলাদেশে ঢুকবে ১১ লাখ কিউসেক পানি। বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদসহ বাংলাদেশেও। বন্যা পরিস্থিতি ও পাহাড়ি ঢলের বিষয়ে আগে থেকে বাংলাদেশকে তথ্য দেওয়া হচ্ছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিবেশী দুই রাজ্যে বন্যার জেরে পানির চাপ পড়েছে। তবে স্বস্তির বিষয়, এখনও নেপাল থেকে পাহাড়ি ঢল নামেনি। ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকায় পানি বিপদসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে বইতে থাকায় বাধ্য হয়ে গেট খুলতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ফিডার ক্যানেলেও পানির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
ফারাক্কা ব্যারেজের জেনারেল ম্যানেজার আর দেশ পাণ্ডে বলেন, ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ সবসময় এলার্ট রয়েছে। প্রতিমুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে। খুব কম সময়ের মধ্যে যেভাবে পানির চাপ তৈরি হয়েছে তাত ১০৯ গেটের সবকটি খুলে না দিল ব্যারাজের ওপর বড় চাপ তৈরি হচ্ছিল। বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। আপাতত ফিডার ক্যানেলে ৪০ হাজার কিউসেক ও ডাউন স্ট্রিমে ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে।
ভারতের দশ রাজ্যে ভারি বৃষ্টির রেড এ্যালাট : ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি)। এই তালিকায় নাম রয়েছে ত্রিপুরারও। সীমান্তবর্তী এই ভারতীয় রাজ্যটিতে সাম্প্রতিক রেকর্ড বৃষ্টিপাত এবং তার জেরে বাঁধের মুখ খোলার ঘটনায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয় প্রতিবেশী বাংলাদেশে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আউটলুক ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কায় লাল সতর্কতা জারি করেছে আইএমডি। বিশেষ করে, দেশটির পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় প্রবল বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। যেসব রাজ্যে আইএমডি রেড অ্যালার্ট জারি করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- গুজরাট, মহারাষ্ট্র, গোয়া, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা। এছাড়া উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক ও রাজস্থানে কমলা সতর্কতা (অরেঞ্জ অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছে। ত্রিপুরায় আরও বৃষ্টিপাতের শঙ্কায় দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় লাল সতর্কতা এবং ধলাই ও গোমতী জেলায় কমলা সতর্কতা বজায় রেখেছে আইএমডি।
বৃষ্টি বাড়বে আবহাওয়া অধিদপ্তর, ঢাকা : উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থানরত লঘুচাপটি বর্তমানে সুস্পষ্ট লঘুচাপ আকারে উপকূলে আঘাত হেনেছে। এতে উপকূল অঞ্চলে বৃষ্টি বাড়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গতকাল সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবীর গণমাধ্যমকে জানান, সাগরের সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উপকূলে আঘাত হেনেছে। এটি উপকূলে বৃষ্টি ঝরিয়ে শক্তি হারিয়ে শেষ হয়ে যাবে। মূলত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আর ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে সুস্পষ্ট লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, খো. হাফিজুর রহমানের দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে সারা দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। এর মধ্যেও সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আগামীকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে যেতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
পানি কমলেও রয়ে গেছে বন্যা : ভোরের আকাশ প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্যে অনুযায়ী, দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে বন্যা। পানি কমলেও এখনো ঘরবাড়ি ফিরতে পারছেন না বন্যা দুর্গতরা। এখনো সাড়ে তিন হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ। কলাগাছের ভেলা দিয়েই অনেকে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার সিলোনিয়া বাজারের একটি আশ্রয়ণকেন্দ্র ঘুরে জানিয়েছেন যে, সেখানে এখনও চার হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছেন। পানি নামতে শুরু করলেও বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের মধ্যে খাবারের পাশাপাশি তীব্র পানি সংকট দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে, গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু-পাখিও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
গতকাল সোমবারও কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। পানি উজানে না ঢুকলেও চট্টগ্রাম বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান। তিনি বলেন, আকস্মিক বন্যার ক্ষেত্রে সাধারণ যেভাবে দ্রুত পানি নামতে দেখা যায়, এবার সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এবার আমরা পানি কমার ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করছি। পূর্ণিমা তিথির মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে সাগরে জোয়ার আরও বেড়ে যায়। এতে নদ-নদীর পানি নিষ্কাশনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”
এছাড়া নদীর নাব্যতা সংকটকেও দায়ী করেছেন অনেকে। সব মিলিয়ে পানি সরতে দেরি হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। আগামী আট থেকে দশ দিনের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাবে বলে আমরা আশা করছি বলে জানান প্রকৌশলী রায়হান।
ভোরের আকাশ/মি