logo
আপডেট : ২৭ আগস্ট, ২০২৪ ১১:৪৩
গাজী টায়ার কারখানা, দুই শতাধিক মৃত্যুর আশঙ্কা
নাফিজ আশরাফ, নারায়ণগঞ্জ ও আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া, রূপগঞ্জ

গাজী টায়ার কারখানা, দুই শতাধিক মৃত্যুর আশঙ্কা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ছে গাজী টায়ার কারখানা, নিখোঁজ সন্তানের খোঁজে এসে এক মায়ের আহাজারী

  • লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ
  • লাঠিসোটা নিয়ে হামলা
  • রাবার ও দাহ্য পদার্থে আগুন ভয়াবহ
  • বিএনপিকে দোষারোপ
  • নিখোঁজরা সব ‘বহিরাগত’



দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে গেছে গাজী টায়ার কারখানা। গত রোববার রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় লুটপাটের পর কারখানাটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুন জ¦লছিল। থেমে থেমে বিস্ফোরণের আওয়াজ আসছিল। টায়ার তৈরি ব্যবহৃত দাহ্য পদার্থ ও রাবারের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এ ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ ভেতরে আটকা পড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে ফায়ার সার্ভিস ১৭৪ জন নিখোঁজের নাম পেয়েছে বলে জানা গেছে। তারা সবাই মারা গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, ভেতরে আটকেপড়া কেউ কারখানার শ্রমিক না। তারা বহিরাগত। মূলত লুটপাট করতে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। তবে নিখোঁজদের কয়েকজন স্বজন বলছেন, ভেতরে বেশ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছিলেন। তারা বের হতে পারেননি।

গতকাল কারখানার বাইরে বিপুল সংখ্যক লোক স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অনেকে আহাজারি করছিলেন। কেউ কেউ গুমরে কেঁদে ওঠেন। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক আর স্বজন হারানোর ছাপ। এদিকে এই অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ককেয়শ লোক লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। তারা বিএনপির পক্ষে সেøাগান দেয়। এর আগে কারখানার মালিক সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।

গাজী গোলাম দস্তগীর নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। রোববার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়েলে বিপুল সংখ্যক দুর্বৃত্ত সেখানে লুটপাট চালায়। এক পর্যায়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন ভেতরে বিপুল সংখ্যক দুর্বৃত্ত লুটপাট করছিলেন। অসমর্থিত একটি সূত্র বলছে, কারখানার মালপত্র লুটপাট করার সময় একটি পক্ষ গেট বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে যখন ভবনটিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল তখনও স্থানীয় কয়েকজন নারী-পুরুষকে কারখানার ভেতর থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে বের হতে দেখা গেছে। কারখানাটির সামনে ও ভেতরে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে কারখানার মূল অংশে লুটপাট না হলেও সুবিশাল এই কারখানা চত্বরের আশপাশে বিভিন্ন অরক্ষিত অংশে লুটপাট চলছে। তারা কারখানা থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, স্টিল, প্লাস্টিক ও তামা লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের খালে কারখানা থেকে নির্গত জ্বালানি তেল সংগ্রহ করতেও দেখা গেছে। কারখানার বাইরের অংশে কয়েকজন জানালা ভেঙে লুট করছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা কথা বলতে রাজি হননি। কয়েকজন আবার ক্ষেপেও যান। তবে এক যুবক বলেন, গাজী আমাগোরতে অনেক খাইছে। এইটা আমাগোই।

সকালে কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, রোববার দুপুরে কয়েকশ লোক কারখানায় ঢুকে পড়ে। তাদের বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। লুটপাটের সময় রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ছয়তলা ভবনটির নীচতলায় আগুন লাগিয়ে দেয় লুটপাটকারীরা। দুপুরে লুটপাট শুরু হলে পুলিশসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানানো হলেও কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (গ-সার্কেল) হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ কোনো অবহেলা করেনি। আমরা কারখানার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামানও কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের বলেছেন। তিনি বলেন, যারা কারখানাটিতে ঢুকেছিলেন তারা কারখানাটিতে লুটপাট করতেই ঢুকেছিলেন। এমনকি তারা টয়লেটের কমোড পর্যন্ত নিয়ে গেছে। খবর পাওয়ার পর থেকে কাজ শুরু করেছি।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর একবার কারখানাটিতে লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল জানিয়ে শিল্প পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তারপর থেকে কারখানাটিতে কোনো গার্ড ছিল না, নিরাপত্তা প্রহরী ছিল না, প্রাচীর বেষ্টনিও ছিল না। অর্থাৎ কারখানাটি পুরোপুরি অরক্ষিত ছিল। এ অবস্থায় বিভিন্ন এলাকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকজন ঢুকে মালামাল, মেশিন লুট করে। এমনকি টয়লেটের কমোডও নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের অনেকগুলো ইউনিট কাজ করছেন। আমরা রাত থেকে কন্টিনিউয়াস ডিউটি করছি, কেবল শিফটিং চেঞ্জ হয়েছেন। এটা তো একটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স। আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী যথেষ্ট কাজ করেছি।

লুটপাটের বিষয়ে রূপগঞ্জ ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কারখানার লুটপাট ঠেকাতে পুলিশ, শিল্প পুলিশ, সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। আমি সবাইকে অনুরোধ করেছি তারা যেন আরো শক্ত অবস্থান নেয়।

স্বজনদের আহাজারি : গতকাল কারখানায় প্রবেশ পথের পাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে নিখোঁজদের নাম লিখছিলেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। সেখানে কথা হয় বরপা এলাকার দিনমজুর শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার ছোট ভাই স্বপন ইসলাম, ভাগিনা সাঈদুল ইসলাম নিখোঁজ রয়েছেন। তারা গাজী টাওয়ারের তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। রোববার রাত বারোটা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে তার ফোনে সঙ্গে কথা হয়। তারা বারবার বলছিলে তাদের বাঁচাতে। রাতে তারা এখানে এলেও আগুনের তীব্রতায় ভেতরে ঢুকতে পারেনি। যদিও তখন শত শত মানুষ ছিল ফ্যাক্টরির সামনে। নাতি নীরবকে (১৭) খুঁজতে এসেছিলেন সুরাইয়া। তিনি আহাজারি করছিলেন। তিনি বলেন, তার নাতি কাজ করতেন যাত্রামুড়া এলাকার নবীন কটন মিলে। যাত্রামুড়া গাজী টায়ার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।

এত দূরে কেন এসেছিলেন তার নাতি এমন প্রশ্নে সুরাইয়া জানান, মিল্লাত নামের তার আরেক বন্ধু তাকে ডেকে এনেছিলেন। মিল্লাত ও নীরব দুজনেই নিখোঁজ। জ্বলন্ত ভবনে কারখানার সামনেই দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি জানান, তার স্বামী মো. সজিব (২৬) রোববার রাত নয়টা থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। সজিব উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজিব রাজমিস্ত্রির সহকারী ছিলেন। রুবি বলেন, কারখানায় লুটপাট হইতাছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত নয়টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায় ছিলেন। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

একই জায়গায় বিলাপ করছিলেন রূপসী মইকূলি এলাকার মো. সজিব ভূঁইয়ার (৩২) স্ত্রী কল্পনা আক্তার। তিনি জানান, তার স্বামী একজন জামদানি ব্যবসায়ী। তাদের কারখানার শ্রমিক মো. সাদ্দাম কারখানা লুটপাটের সময় আসেন। তার খোঁজে রাত ১০টায় কারখানায় আসেন সজিব। রাত সাড়ে দশটায় সজিব মায়ের মুঠোফোনে ফোন করে তাকে বাঁচানোর আকুতি জানান। তারপর আর সজিবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ ছেলে সজীবকে খুঁজতে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা কুলসুম বেগম বলেন, আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। গতকাল (রোববার) এখানে এসেছিল। রাত থেকে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাচ্ছি। কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারছি না। কারখানাটির অদূরে কলাবাগ এলাকার বাসিন্দা মনি জানান, তার স্বামী মো. রাশেদ রোববার সাড়ে ৮টার দিকে গাজী টায়ার কারখানায় এসেছিলেন। ওই এলাকারই আরেক বাসিন্দা তখন তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু রাতে তার স্বামীর বাসায় না ফেরায় তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করেও তা বন্ধ পান।

কারখানাটি রূপগঞ্জের তারাবো পৌরসভায় হলেও একই থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের খতিয়ান গ্রামের ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে নিখোঁজ নজরুলের ছেলে ফটিকের নিকট ঐ ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার কারণ এবং সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন লোহা লক্কর আনতে রাত নয়টার দিকে এলাকার আরো লোকজনের সঙ্গে আমার বাবাও সেখানে যায়। একই কথা বলেন নিখোঁজ ফজলুল হকের বড় ভাই মুবিন।

তাদের মতো আরো অন্তত ১৭০ জন নিখোঁজ বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের উপ-সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন। এই ১৭০ জনের আত্মীয়রা তাদের স্বজন নিখোঁজ বলে ফায়ার সার্ভিসের কাছে নাম লিখিয়েছে।

স্থানীয়রা যা বলছেন : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একজন দোকানদার জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে গাজী গোলাম দস্তগীরের রিমান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে। রূপসী বাসস্ট্যান্ডে মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দীপুর লোকজন মিষ্টি বিতরণ করে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী মনিরের সমর্থকরা কয়েকশত মোটরসাইকেল নিয়ে মহাসড়কের একটি শো-ডাউন করে। গাজীর কুশপুত্তলিকা দাহ করে। শো-ডাউনের কিছুক্ষণ পর গাজী টায়ারে লুটপাট শুরু হয়। এর আগে তিন-চারশত লোক ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা নিয়ে গাজী টায়ার কারখানায় হামলা চালায়। এ সময় প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় শ্রমিকরা কাজ করছিলেন। হামলাকারীদের ভয়ে শ্রমিকরা বের হয়ে যেতে পারেননি। অন্যদিকে লুটপাটকারীরা তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা থেকে মালামাল নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। রাত নয়টার দিকে প্রতিষ্ঠানের পেছন দিয়ে ঢোকা একদল লুটপাটকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলায় স্লোগান দিতে দিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনের কারণে উপরে শ্রমিকরা ও লুটপাটকারীরা আটকে পড়ে।

ঘটনা সম্পর্কে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান জানান, গাজী অপরাধ করেছেন। এজন্য তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু তার ফ্যাক্টরিতে হামলা করা, আগুন লাগিয়ে দেওয়া আমি সমর্থন করি না। কারণ এই ফ্যাক্টরি সবার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে গাজী আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়েছেন। সেগুলো আমি আইনিভাবে মোকাবিলা করেছি। রাজনীতির সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দীপু বলেন, আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীরা’ এখনো তৎপর। তাদের কাছে এখনো অস্ত্র আছে। তিনি বলেন, গাজী গ্রেপ্তার হওয়ার পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা আনন্দিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন নির্যাতিত ছিলেন। যারা এই ফ্যাক্টরিতে আগুন দিয়েছেন; তারা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে তারাবো পৌর বিএনপির সেক্রেটারি পিন্টু চাচাসহ ওয়ার্ড বিএনপির নেতারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। ঠেকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই মারধরের শিকার হয়েছে। যার ভিডিও আমাদের কাছে আছে। তবে গাজী ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগানো আমি সমর্থন করি না। গাজী অপরাধ করে থাকলে তার ফ্যাক্টরি সরকার নিয়ে চালাবে। কিন্তু আগুন দিয়ে সম্পদ নষ্ট করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম জানান, স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিখোঁজদের প্রাথমিক এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তা পুলিশকে দেওয়া হবে। পুলিশ তদন্ত করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত তথ্য জানাবে। রূপগঞ্জের রূপসীতে অবস্থিত গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একে একে ১২টি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানো শুরু করে। ১২০ জন ফায়ার ফাইটার এখানে কাজ করছে। প্রায় বিশ ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বলছে। আগুন লাগা ভবন থেকে আমরা ১৪ জনকে উদ্ধার করেছি। এখানে টায়ার বানানোর রাবার, প্লাস্টিকসহ নানা উপাদান ছিল। এর মধ্যে কিছু ছিল দাহ্য পদার্থ। যে কারণে আগুন দ্রুত ভবনে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আগুন নেভানোর পরে আমরা পুরো ফ্যাক্টরিতে তল্লাশি চালিয়ে দেখব। এরপর আমরা নিখোঁজদের ব্যাপারে বলতে পারবো।

রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জুবায়ের হোসেন জানান, নিখোঁজদের কেউ এখনো থানায় রিপোর্ট বা জিডি করেনি। তবে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশও আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছে।

কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : গাজী টায়ারে কোনো শ্রমিক ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে গাজী গ্রুপের রূপগঞ্জে অবস্থিত সকল ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে। ৫ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে রূপসীর গাজী টায়ার এবং কর্নগোপে অবস্থিত গাজী ট্যাংক, গাজী পাম্প, গাজী ডোর, গাজী পাইপÑ এই সব ফ্যাক্টরিতেই দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে মালামাল নিয়ে যায়। ৫ তারিখের পর থেকে আমাদের সিকিউরিটিদের ভয় দেখিয়ে লুটপাট অব্যাহত ছিল। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিএনপি নেতাদের হাতে পায়ে ধরেও লুটপাট ঠেকানো যায়নি। গত রোববার বিকেল থেকে পুনরায় গাজী টায়ারে ৫-৭শ দুর্বৃত্ত লাঠিসোটা নিয়ে হামলা ও লুটপাট শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা টায়ার ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন আগুন ধরিয়ে দেয় তখন এ ফ্যাক্টরি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। আমাদের কোনো শ্রমিক ফ্যাক্টরিতে ছিল না। শুধু আমাদের সিকিউরিটি সদস্য এটির পাহাড়ায় ছিল। রূপগঞ্জে অবস্থিত গাজী গ্রুপের পাঁচটি কারখানায় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। গাজী টায়ার গত ২০-২২ ঘণ্টা ধরে আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এসব ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন কিভাবে দেওয়া হবে, তাদের কাজের কি হবে সে নিয়ে সবাই শঙ্কায় আছে। ফ্যাক্টরিগুলো লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে এক যোগে দশহাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে স্থানীয়দের মাধ্যমে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস। ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে যোগ দেয় ১২টি ইউনিট। ভবনটির ভেতরে আটকা পড়ে আছেন অনেক লোক। আটকা পড়াদের জন্য তাদের পরিবার-পরিজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে কারখানা এলাকা। অনেকে বলছেন, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তারের পর থেকে কারখানাটিতে গণহারে লুটপাট চলে। আগুন লাগার সময়ও লুট করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষ বের হয়ে আসতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়ে শতাধিক মানুষ।

ফায়ার সার্ভিস যা বলছে : ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, অবকাঠামোগত ও ভেতরে থাকা টায়ার উৎপাদনের দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা ও ভেতরে আটকা পড়াদের উদ্ধারের ব্যাপারটি জটিল হয়ে পড়েছে। আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছুই ধারণা করা যাচ্ছে না। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১৭৪ জন নিখোঁজের তালিকা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম।

তিনি বলেন, যারা দাবি করছেন যে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছেন, যারা গতরাতে (রোববার) লুটপাটের সময় এই কারখানায় এসেছিলেন। আমরা তাদের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছি। এই মুহূর্তে তা যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। স্বজনরা যারা দাবি করছেন তাদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখছি। এখন পর্যন্ত এ তালিকায় ১৭৪ জনের নাম লেখা হয়েছে। তবে তারা কেউ কারখানার শ্রমিক নন বলে জেনেছি আমরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তারের পর কারখানাটিতে লুটপাট শুরু করে দুর্বৃত্তরা। রাতে আগুন লাগার সময়ও লুট করতে গিয়ে অনেকে ভেতরে আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা তাদের উদ্ধার করেন।

ভোরের আকাশ/ সু