শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ফলে দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলের অবসান নানা দিক থেকে শূন্যতা তৈরি করেছে। এই শূন্যতার একটি জায়গা হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। শেখ হাসিনা শাসনামলের সব থেকে বড় সফলতার জায়গা বিবেচনা করা হয় তার কূটনৈতিক সাফল্য। বিশেষ করে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন দুটি দেশ ভারত এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একথা বেশি প্রযোজ্য।
চীন এবং ভারতের সঙ্গে যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি পূর্ববর্তী সরকার গ্রহণ করেছিল তা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনের পেছনে এই দুটি দেশে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা এবং দৃঢ় সমর্থন যে ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিনির্মাণের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই দুটি শক্তিধর দেশ ভারত এবং চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং আস্থার জায়গায় নেওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কাজটি নতুন সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং।
প্রথমেই ভারতের কথায় আসি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এই গুরুত্বের প্রধান জায়গা হচ্ছে পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তা। পারস্পরিক স্বার্থ এবং নির্ভরশীলতাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা যেখানে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জও এখন সব থেকে বেশি।
বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত যে নীতি এবং কৌশলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেছে বলা বাহুল্য সেটি ছিল বাংলাদেশের জনমানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীত। এরই রেশ ধরে দেশের জনমত দীর্ঘদিন ধরে প্রবল ভারতবিরোধী। বর্তমান পরিস্থিতি সেই ভারতবিরোধী মনোভাব আরো চাঙ্গা করেছে। ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এটি ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি দেওয়াল উঠিয়ে দিয়েছে। এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় শেখ হাসিনা ভারত না গিয়ে বিকল্প কোনো দেশ বেছে নিলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগানো আরো সহজ হতো। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ভারত শেখ হাসিনার এরূপ পরিণতি এবং তড়িঘড়ি করে ভারতে যাওয়ার আবেদন ভারতের কাছে অনভিপ্রেত ছিল। এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতি যে ভারতের ওপর বিরাট চাপ তৈরি করছে সেটিও স্পষ্ট।
যদিও ঘটনার অব্যবাহিত পরেই ভারত সরকার পরিষ্কার করে শেখ হাসিনা সে দেশে পাকাপাকিভাবে থাকছেন না। এই ঘোষণার মাধ্যমেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান যেমন ভারতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে একইভাবে সেটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভারতনীতির জন্যও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের প্রধান দিক হচ্ছে আস্থা এবং বিশ্বাসের ঘাটতি । ব্যাপক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দুই দেশই একটি স্থিতিশীল সম্পর্কের ব্যাপারে তাগিদ অনুভব করছে। আর এই তাগাদা অনুভবের কারণ হচ্ছে পারস্পরিক স্বার্থ।
এই মুহূর্তে চীন ভারতের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশে এবং অন্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের বড় অভিযোগের জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। বর্তমান সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতির মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ক্ষমতার পালাবদলদের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশসমূহকে আশ্বস্ত করতে হবে।
প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে বরফ গলা পর্ব শুরু হতে হবে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে। এই আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একইভাবে ভারতকে আশ্বস্ত করতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভারত আন্তরিক এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগেও উল্লেখ করেছি এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হবে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান। শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করলে সেটি স্বভাবতই সম্পর্কে ছায়াপাত করবে। ভারতের এই ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তে আসা ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আমার মতো।
এবার আসা যাক চীনের কথায়। চীনের জন্য শেখ হাসিনার বিদায় স্বাভাবিকভাবেই একটি ধাক্কা। শেখ হাসিনার আমলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বহুমুখী সম্প্রসারণ ঘটেছেÑ দুটি দেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ চীনের দক্ষিণ এশিয়া তথা ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে অন্যতম অংশীদার। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের কাছে বিশেষ গুরুত্বের জায়গায় আসীন। শেখ হাসিনার বিদায়ে চীন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন।
এই উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাইথ এশিয়ান রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক লি চোংইর কথায়। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভবিষ্যৎ সমঝোতার ব্যাপার সন্দিহান। এবং তিনি মনে করেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকতে পারে যদি একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় উপনীত হওয়া না যায়। চীনের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে যে উদ্বিগ্ন সেটি চীনা গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংবাদ দেখলেই বোঝা যায়।
এই উদ্বিগ্ন যতটা না ভূকৌশলগত তার থেকে বেশি ব্যবসায়িক এবং বাণিজ্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট। চীন সবসময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বিনিয়োগের জন্য বিপজ্জনক বিবেচনা করে। চীন মনে করে বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যায় সেক্ষেত্রে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভারতের তুলনায় নিকটবর্তী হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের আন্তরিক সদিচ্ছার কথা জানিয়েছেন।
এমতাবস্থায় ভারত চীন এবং অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দিতে হবে- যেটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তিও বটে। ভারত ও চীন উভয়কেই আশ্বস্ত করা যে বাংলাদেশ উভয় দেশের সঙ্গেই তার সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে এবং সম্পর্ক বৈরী হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ এড়িয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় ও চীনা উভয় পক্ষের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা শুরু করা, যা বাংলাদেশের উদ্দেশ্য এবং অগ্রাধিকার স্পষ্ট করতে সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত সংলাপ পারস্পরিক সমঝোতা বাড়াবে এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান থেকে উদ্ভূত যে কোনো উদ্বেগের সমাধান করতে পারে। এই আলোচনার একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে কাজ করার বিষয়।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি যে বৃহত্তর ঐক্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য সামনে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছে এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেশ করা। চীনা বিনিয়োগকারী এবং নীতিনির্ধারকরা আগে যেটিকে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বলতেন সেটির মধ্যেই যে আসলে অস্থিতিশীলতার বীজ ছিল সেটি ব্যাখ্যা করা জরুরি। পুরো বিষয়টি বোঝানো গেলে চীনের উদ্বেগ প্রশমিত হবে এবং তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের নতুন ধারায় দারুণ আগ্রহী হবে বলে আমি মনে করি।
এই মুহূর্তে চীন ভারতের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশে এবং অন্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের বড় অভিযোগের জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। বর্তমান সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতির মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ক্ষমতার পালাবদলের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশসমূহকে আশ্বস্ত করতে হবে। এই ব্যাপারে দৃশ্যমান উদ্যোগ এবং অবস্থার উন্নতি এসব দেশকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে উৎসাহী করবে।
সর্বশেষ বাংলাদেশের জন্য এখন সব থেকে জরুরি অর্থনৈতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জোরদার করা। নানা কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সংকটকালীন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ ২০২৩ সালে ২০২২ এর তুলনায় ১৭ শতাংশ কমে গেছে এবং ২০২৩ এর তুলনায় কমে গেছে ৪ শতাংশ। ফরেইন রিজার্ভও তলানিতে এছাড়া বৈদেশিক ঋণের খড়গ তো আছেই। এই সংকটময় পরিস্থিতি কাটাতে অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং এক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
লেখক : শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব কম্বোডিয়া, কম্বোডিয়া।
ভোরের আকাশ/মি