logo
আপডেট : ২৯ আগস্ট, ২০২৪ ১১:৫৭
আপনিও হতে পারেন ‘অজ্ঞাতনামা’
আহসান কবির

আপনিও হতে পারেন ‘অজ্ঞাতনামা’

ক্রিকেটে পাকিস্তানের সঙ্গে সেই দেশের মাটিতে বাংলাদেশ দশ উইকেটে জয়ের পর একটা কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে। কৌতুকটা এমন ‘ক্রীড়া উপদেষ্টা কী উপহার চাই আপনাদের? গাড়ি, ফ্ল্যাট নাকি নগদ অর্থ?’

কেউ কিছু বলছে না দেখে সাকিব আল হাসান বললেন ‘আমি কিছু চাই না। খুনের মামলার আসামি হিসেবে যখন আমাকে আদালতে নেওয়া হবে, তখন কি আমি ফুলপ্যান্টের নিচে ওই বিশেষ গার্ডটা পরতে পারবো?’

মামলাও কখনও কখনও কৌতুককর হয়। কাউকে ধ্বংস করার জন্য নাকি তিনটি তিতা আর একটা মিষ্টি উপায় আছে। তিনটা তিতা উপায় হচ্ছে নেশাসক্ত করে তোলা, জুয়া খেলায় আসক্ত করা আর মামলায় জড়িয়ে ফেলা। মিষ্টি উপায়টা হচ্ছে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। আজকের লেখার বিষয় ধ্বংস করার বা হওয়ার জন্য তিন তিতা উপায়, যার তৃতীয়টা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে কোনো একদিন! আজ আপনি দম্ভ নিয়ে কাউকে জঙ্গলের মধ্যে কলাপাতায় শুয়ে থাকতে বাধ্য করছেন, কাল আপনার জীবনে সেই দিনটা ফিরেও আসতে পারে! সে কারণে ছবির নাম হয় আজ আমার কাল তোমার (টুডে ইটস মি টুমরো ইউ!)

মানুষের অনেক নেশা থাকে। সবচেয়ে বড় নেশা নাকি ক্ষমতায় থাকার নেশা। এদের বলা হয় ক্ষমতা মাতাল। কবি শামসুর রাহমান যেমনটি লিখেছিলেন ক্ষমতা মাতাল জঙ্গি প্রভুরা শোনো...! ক্ষমতায় থাকলে জুয়া বা ব্যাংক খেলাও ভালো জমে। কয়েক দানে মানুষের হাজার কোটি টাকা যেমন মেরে দিতে পারতেন ঋণের নামে, যেমন শেয়ার বাজারে ধস নামাতে পারতেন ব্যবসায়ী ও পতিত শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, যেমন কয়েক দানে সাতটা ব্যাংক খেয়ে ফেলতে পারতেন এস আলম গ্রুপের মালিকরা, ক্ষমতার জুয়া খেলাটা তেমনই। কিন্তু তৃতীয় তিতা বিষয়টা?

তৃতীয় তিতা বিষয় ‘মামলা’ হচ্ছে বিরোধী দল দমনের সবচেয়ে বড় আইনি অস্ত্র। বিভিন্ন আমলে মামলার চরিত্রগুলো কিন্তু ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পূর্ণ এবং কৌতুককর। যেমন ধরুন, আপনি কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আপনাকে সাইজ করতে চায় নতুন সরকার। আপনার বিরুদ্ধে থালা-বাটি কেনায় দুর্নীতির মামলা দেওয়া হলো এবং আপনি জেলে গেলেন। সরকার আপনাকে ভিসি পদ থেকে সরাতে পারলো এবং অনুগত নতুন কাউকে বসানো হলো। ধরুন আপনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আপনি যখন ক্ষমতায় নেই তখন আপনার বিরুদ্ধে বঙ্গভবনের পর্দা কেনাতে নয় ছয় করার মামলা দেওয়া হলো এবং আপনি জেলে গেলেন। মামলার এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি এবং ক্ষমতার পালাবদল হলে মামলা কেন যেন পুরনো ঐতিহ্য নিয়েই ফিরে আসে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও এমন মামলা দিতো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। একই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশে ফেরিতে ভাঙচুর ও বাসন কোসন নষ্টের দায়ে এমপির বিরুদ্ধে মামলা হবার রেওয়াজ আছে। সিনেমা হলে বোমা ও অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের দায়ে শিক্ষকদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা আছে। আবার মামলার পরিণতির জন্য জজ মিঞার গল্প ফাঁদারও রেওয়াজ আছে। এই গল্প ছড়ানোর দিন কি আবারও ফিরে এলো?

ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর মামলার এই ঐতিহ্যপ্রিয়তা এবং পুলিশি গল্প বদলে যাবে, এমন আশাই করেছিলাম আমরা। কারণ ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে মামলাবাজিতে কিছু নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে মামলার সংখ্যা বাড়ানো ও অজ্ঞাতনামা যোগ। গত ১৬ বছরে বিএনপির যেসব নেতার নামে দুইশর বেশি মামলা হয়েছিল, দিনে হয়তো তার বা তাদের কয়েকটা মামলার হাজিরা থাকতো। দিন যেত তখন আদালত প্রাঙ্গণে হাজিরা দিতে রাজনীতি, ব্যবসা কিংবা চাকরি তার বা তাদের পক্ষে করা অসম্ভব ছিল। যে পত্রিকা স্বাধীনতা দিবসে মাংস খাবার স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্ট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে দেশের একাধিক স্থানে মামলা করা হয়েছিল। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের নামেও দেশের একাধিক স্থান থেকে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছিল।

এই ধারা অব্যাহত ছিল, এখনও আছে। আদালতে নেওয়ার পথে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের ওপর হামলা হয়েছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে মানুষকে নিগ্রহ করার এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? যে পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে গল্প ফাঁদা, গ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামার চল প্রচলন করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কি আরও কিছু মাত্রা যোগ হয়েছে?

কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক...
পোশাককর্মী রুবেল হত্যা মামলার ২৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে ক্রিকেটার কাম সাবেক এমপি সাকিব আল হাসানকে এবং ৫৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে চিত্রনায়ক ও সাবেক এমপি ফেরদৌসকে। রুবেল হত্যার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, সাকিব তখন ছিলেন বিদেশে। ধরে নিচ্ছি ক্রিকেট টিমে থাকাকালীন ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে ভোটারবিহীন ডামি নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থী হওয়ার কারণে সাকিবের ওপর অনেকেই নাখোশ। সাকিব আল হাসান কিছু কাজ করে আগেই বিতর্কিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মামলা দেওয়া যেত। যেমন ই-অরেঞ্জের প্রতারণা বা শেয়ার কেলেঙ্কারি, আরাভ খানের সঙ্গে সোনার ব্যবসা, ক্রিকেট জুয়ার সঙ্গে জড়ানো, এমনকি কোনও কোনও তরুণীর মন ভাঙার জন্য মামলা দেওয়া যেত। কিন্তু খুনের মামলা কেন? চিত্রনায়ক ফেরদৌস হয়তো আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী ছিলেন, কিন্তু তিনি কি খুনের সঙ্গে জড়িত?

বিবিধ কারণে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন। প্রথমবার যখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তার নাম হয়েছিল ‘ভ্রমণপাখি’। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিয়োগ ও বদলি, নিজ নির্বাচনি এলাকায় দখল বাণিজ্য, বালুখোর সেলিম খানের দৌরাত্ম্য এসব নিয়ে নির্দিষ্টভাবে মামলা হতে পারতো। এই সরকারের আমলে খুনের নীচে মামলা নেই, তাই খুনের মামলায় জড়িয়ে যে প্রক্রিয়ায় তাকে আদালতে আনা ও নেওয়া হলো, বাংলাদেশে তেমন কিছু আগে কখনও ঘটেনি। একজন নারী নিগ্রহ ও গণপিটুনির সম্মুখীন হলেন চারদিকে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার সেই অমর ডায়ালগ ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’র মতো এসব ঘটনাও কি জমা হবে ভবিষ্যতের ব্যাংকে? আসামিকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন এই সরকার?

একই কথা খাটে সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রূপা ও শাকিল আহমেদের ক্ষেত্রে। শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্ন সেক্টরে তাঁবেদার ও স্তাবক তৈরি করেছিলেন। রূপা-শাকিল দম্পতি যদি কোনও সুবিধা নিয়ে থাকেন, বিরোধী মতের মানুষদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে থাকেন, তাহলে সেসব অভিযোগ নির্দিষ্টভাবে দায়ের করা যেত। কোনো হত্যা মামলায় এই দুজনের নাম ছিল না। তাদের নাম অজ্ঞাতনামার তালিকায় সংযুক্ত করা হয়েছে।

জজ মিঞার গল্পের পর বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল ক্রসফায়ারের গল্প। যেমন ‘গ্রেপ্তারকৃত পিচ্চি হান্নানকে নিয়ে গভীর রাতে অস্ত্র উদ্ধারে নামে র‌্যাব। এ সময় ওত পেতে থাকা পিচ্চি হান্নানের সহযোগীরা গুলি ছোড়া শুরু করলে র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। গুলি ও পাল্টা গুলির মাঝে গুলিবিদ্ধ হয় পিচ্চি হান্নান। তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।’ গত কয়েক দিনে এমন আরও কিছু গল্প পেয়েছি আমরা। যেমন দীপু মনি তার বোনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। পড়তে বসতে বলার কারণে বোনের ছেলে ৯৯৯ নম্বরে টেলিফোন করে দীপু মনির উপস্থিতির কথা পুলিশকে জানায়। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, এখন যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তারা সেনাবাহিনীর হেফাজতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাহলে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ঋণখেলাপি সালমান এফ রহমানের দাড়ি কেটে নৌপথে পালানোর গল্পটা কী মানুষ বিশ্বাস করেছে? নাকি অগণিত মানুষ, যারা কোনও কিছু খতিয়ে দেখে না, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য এমন গল্প? কিন্তু তাদের আদালতে আনার পথে যেভাবে প্রহার করা হয়েছে সেটা সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছেন। ১৬ বছরের অত্যাচার কি ১৬ দিনে মিটিয়ে ফেলার জিঘাংসা এসব?

বিতর্কিত বিচারক শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে সহসাই যেতে পারতেন বিদেশে কিংবা আশ্রয় নিতে পারতেন ব্রিটিশ দূতাবাসে। তার পলায়নের গল্প, কলাপাতায় শুয়ে থাকা, তার টাকা দালালদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনা, এসব কাদের জন্য সাজানো হয়েছে? মানিক সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পর কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশের পাহারায় পেটানো ও অণ্ডকোষে আঘাত করা কীসের লক্ষণ?

আগে বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা নিগ্রহ, মামলা হামলার শিকার হতেন। সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতাকর্মী, সমর্থকরা গাঢাকা দিয়েছেন। এদের ছেড়ে যাওয়া জায়গা, যেমন বাজার, বাসস্ট্যান্ড, ঘাট কিংবা পরিবহন দখলে নিচ্ছেন বিরোধীরা। জোর করে পদত্যাগের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাস্তা দখল করে যে কেউ দাবি দাওয়া পেশ করছে, জ্যাম দীর্ঘতর হচ্ছে।

সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে জড়ো হওয়া, অটোপাস আদায় করে নেওয়াতে ক্ষতি হলো কাদের? শুধু আওয়ামী লীগকে সমর্থনের কারণে রাজনীতি না করা সংস্কৃতি কর্মীদেরও জড়ানো হচ্ছে মামলায়। যেমন জায়েদ খান, শাহরিয়ার নাজিম জয় ও অভিনেতা সাজু খাদেম।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলের হামলা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে নিগ্রহ আর তাদের মনগড়া মামলার মতো এই আমলে পুলিশের উপস্থিতিতে নিগ্রহ, উদ্ভট মামলা আর গল্প ফাঁদার এই প্রবণতা অটোপাস পেয়ে যাবে এমন ধারণা ভুল। ফ্রাংকেস্টাইন শেষমেশ তার স্রষ্টাকেই বধ করে!

প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেমন বলেছিলেন ‘আমরা যেন ভুল পথে হেঁটে এই সুযোগ না হারাই’! কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা কি সেই কাজটাই বেশি বেশি করছি না?

লেখক : রম্যলেখক

ভোরের আকাশ/ সু