logo
আপডেট : ৩০ আগস্ট, ২০২৪ ১২:২৪
শিমুলিয়ায় টোল আদায়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা
মারধরে উধাও ইজারাদারের লোকজন
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

শিমুলিয়ায় টোল আদায়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা

মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে টোল আদায় করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদ্মার শিমুলিয়া ফেরিঘাট, মাছঘাট ও ট্রলারঘাট দখল করেছেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা বৈধ ইজারাদারের লোকজনকে মারধর করে ঘাট থেকে বের করে দিয়েছেন। এরপর থেকে সেখানে তারাই টোল আদায় করছেন। প্রতিদিন লাখ টাকা টোল আদায় করছেন তারা। উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কাউসার তালুকদারের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা এ কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে শিমুলিয়া ফেরিঘাটটি যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রী পারাপারেও ব্যবহার হতো। সেতু উদ্বোধনের পর যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী সেখানে বেড়াতে আসেন। সেখানে আসা মোটরসাইকেল থেকে ২০ টাকা এবং প্রাইভেট কার থেকে ৪০ টাকা করে টোল আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া তারা বড় হোটেল থেকে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা এবং ছোট হোটেল ও দোকান থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

সূত্র জানায়, চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে লৌহজং উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মোল্লা ১ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ঘাটের ইজারা নেন। একই সঙ্গে ৮ লাখ টাকায় দুটি ট্রলার ঘাট এবং ১০ লাখ টাকায় একটি মাছঘাটেরও ইজারা নেন তিনি।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। এ সুযোগে স্থানীয় কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কাউসার তালুকদারের নেতৃত্বে ইউনিয়ন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের একটি দল ঘাটের সব ব্যবসা দখল করে নেন। তারা ইজারাদারদের লোকজনকে টোল আদায়ে বাধা দেন। ১৬ আগস্ট ঘাটের পার্কিং, ট্রলারঘাট, দোকান, রেস্তোরাঁ থেকে তারা (কাউসারের লোকজন) নিজেরাই টাকা তুলতে শুরু করেন। পরদিন ঘাটের দায়িত্বে থাকা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শেখ মেহেদি হাসানকে বিএনপির ওই দলটি মারধর করে ঘাট থেকে বের করে দেয়। পরে ইজারাদার সুলতান মোল্লা বিএনপি নেতা কাউসার তালুকদারের সঙ্গে সমঝোতায় আসেন। দেনদরবারের পর মোট আয়ের ৬ আনা (৩৭.৫ শতাংশ) কাউসার তালুকদারকে দিতে রাজি হন। তবে কাউসার তালুকদার শর্ত জুড়ে দেন যে, তার লোকজন ঘাটের টাকা তুলবে এবং ইজারাদারের ভাগের টাকা কাউসার নিজ হাত দিয়ে দেবেন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে মেনে নেন ইজারাদার সুলতান মোল্লা।

এ বিষয়ে সুলতান মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, মাছঘাট, ট্রলারঘাট, শিমুলিয়া ঘাট- সবকিছুই কাউসার তালুকদার ও তার লোকজনের দখলে রেখেছেন। আমরা কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছি। অথচ তারা বিনিয়োগ ছাড়াই ৩০ ভাগের বেশি আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তাদের লোকজন টাকা তুলছেন। তারা এখনো আমাদের ভাগের টাকা দেননি। তবে বিএনপির লোকজনের ভয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি সুলতান মোল্লা। তিনি বলেন, ৩০ আগস্ট টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হওয়ার কথা। জানি না, সেদিন তারা কী করবেন।

তবে দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএনপি নেতা কাউসার তালুকদার। তিনি বলেন, কিছু ছাত্র, পোলাপান ঘাটে এসে ইজারাদারদের বিরক্ত করছিল। ইজারাদারকে নিয়ে ইউএনও সাহেবের সঙ্গে বসেছিলাম। ইউএনও সরকারি ইজারা যেন নষ্ট না হয়, আমাদের দেখে রাখতে বলেছেন। টাকা তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টি মিথ্যা। টাকা তোলার কাজে সেখানে শুধু আমাদের লোকই নয়, ইজারাদারের লোকজনও আছে। টাকা তুলে জমানো হচ্ছে। পরে এগুলো কীভাবে কী করা হবে, নির্ধারণ করা হবে।

লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, কাউসার সাহেবেরা যে কথা বলছেন, এমন কোনো কথা তাদের সঙ্গে আমার হয়নি। সরকার পতনের কয়েকদিন পর ঘাটের বিষয় নিয়ে কাউসার লোকজন নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদের পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম।

প্রতিদিন কত টাকা আদায় :

সরেজমিন দেখা যায়, ঘাটের পার্কিং মাঠের প্রবেশমুখে কয়েকজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার থামিয়ে টাকা তুলছেন। তারা জানান, তারা কাউসার তালুকদারের লোক। দিনপ্রতি ৫০০ টাকা মজুরিতে তারা কাজ করেন। পার্কিংয়ের টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকা মো. আল আমিন বলেন, মোটরসাইকেল প্রতি ২০ টাকা, প্রাইভেটকার থেকে ৪০ টাকা নেওয়া হয়। কিছুদিন আগে সুলতান মোল্লার লোকজন টাকা তুলতেন। এখন কাউসার তালুকদারের লোকেরা তোলেন। প্রতিদিন পার্কিং এলাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা তোলা হয়। এ ছাড়া মাঠে ১৫টি বড় খাবারের হোটেল এবং প্রায় আড়াই শতাধিকের মতো চা, কফি, শিশুদের খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্যের ছোট দোকান রয়েছে। এসবের মধ্যে খাবারের হোটেল থেকে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা এবং ছোট দোকান থেকে ২৫০ টাকা করে ভাড়া তোলা হচ্ছে। টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন কাউসারের অনুসারী কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, কুমারভোগ ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সোহান মৃধা, ছাত্রদল নেতা মিলন ঢালী, ইউনিয়নটির ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি ইলিয়াস মাদবর, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা অনিক হোসেন প্রমুখ। সব মিলিয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা অবৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছেন কাউসার তালুকদারের লোকজন।

জানা যায়, মাছ ঘাট থেকে টাকা তোলেন লৌহজং উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সোহাগ মৃধা। ট্রলার ঘাট থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা পারভেজ খান এবং বাসস্ট্যান্ড দখল করে শ্রমিক দলের নেতা জাকির হোসেন টাকা আদায় করছেন। সোহান মৃধা বলেন, আমি একদিন ঘাটে গিয়েছিলাম। কাউসার তালুকদার চারজনকে ঘাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি এগুলোর মধ্য নেই।

কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন টাকা তোলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, টাকা কীভাবে ভাগ হবে; তা সভাপতি কাউসার তালুকদার জানেন।

স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, দল যেখানে সব বিতর্কের বাইরে থাকতে চাইছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে সুন্দর একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছে, সেখানে কাউসার ও আনোয়ারের মতো বিএনপির নামধারী কয়েকজন নেতারা আবার সেই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছেন। তারা ক্ষমতা দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতার ইজারা নেওয়া ব্যবসা নিজেদের দখলে নিয়ে টাকা তুলছেন।

মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব কামরুজ্জামান রতন বলেন, শিক্ষার্থীরা একটি বৈষম্যবিরোধী দেশ গড়তে রক্ত দিয়েছেন। আমরাও এমন দেশ চাই। শুধু কুমারভোগ নয়, মুন্সীগঞ্জের যেখানেই দলের নাম ভাঙিয়ে যারা অন্যায় কাজ করছেন; তাদের বিরুদ্ধে আইনগত এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভোরের আকাশ/ সু