বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৫২ বছরে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে মাত্র একটি নদীর। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন’ অনুমোদনের সময় এর পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দিলেও অনুস্বাক্ষর করেনি। ফলে আন্তঃসীমান্ত কোনো নদীর পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হলে তা মীমাংসার জন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারছে না বাংলাদেশ। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করলে উজানের দেশ হিসেবে ভারত ইচ্ছামতো পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারতো না। আইন লঙ্ঘন করলে দেশটি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকতো।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকায় বাংলাদেশ, ভারত চীন, ভুটান ও নেপাল- পাঁচটি দেশ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভাটিতে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র হিমালয় থেকে এবং মেঘনা বরাক থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি ও সেচখাত মূলত এসব নদীর ওপরই নির্ভরশীল। এজন্য স্বাধীনতার পরই ভারতের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা ও পানিবণ্টন ইস্যুটি গুরুত্ব পায় এবং ১৯৭২ সালে দুই দেশের উদ্যোগে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন। কিন্তু ৫২ বছরে গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি দুই দেশ।
বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪। এর মধ্যে শুধু গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছে। এর বাইরে আরো ৯টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে নদী কমিশন কাজ করেছে। এ তালিকায় রয়েছে- তিস্তা, ফেনী, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী ও কুশিয়ারা। সব মিলিয়ে নদী কমিশন গত ৫২ বছরে ১০টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কাজ করেছে। বাকি ৪৪টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেই।
মূলত ফারাক্কা বাঁধকে ঘিরেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর এ বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। তবে নির্মাণ কাজ শুরুর ১০ বছর আগে ১৯৫১ সালে এ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উদ্বেগ জানিয়েছিল। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পানিবণ্টনের জন্য গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন। তবে বাংলাদেশ ও ভারতে বারবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ নানা কারণে এ কমিশন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারেনি।
ভারতের সঙ্গে নদী নিয়ে যেসব বিরোধ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাঁধটির নির্মাণ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন উভয় দেশের সরকারপ্রধানদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, গঙ্গার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে দুই দেশের ঐকমত্য ও চুক্তির আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু হবে না। এরপর ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষার জন্য ভারতের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে বাঁধ চালুতে সম্মত হয় বাংলাদেশ। তবে এরপর পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কায় ১৯৭৬ সালে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ।
জাতিসংঘ বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ ১৯৭৭ সালে প্রথমবার একটি পাঁচ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। মেয়াদ শেষে অনেক বছর এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি ছিল না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি আবার সামনে আসে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে ৩০ বছরের এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন; যার মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হচ্ছে।
গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী, বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টন হতে থাকে। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় অনুযায়ী ভারত গঙ্গার পানির ভাগ পেতে থাকে। চুক্তিতে, যেকোনো সংকটে বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়। এছাড়া চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার অন্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টনের বিষয়েও দুই দেশ ভবিষ্যতে চুক্তি করবে।
তিস্তা নদীর পানি নিয়েও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহু বছর যাবত আলোচনা চলছে। ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায়ই তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৮৩ সালে অন্তরবর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তরবর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি।
১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন গৃহীত হয়। ১০৩টি দেশ কনভেনশনের পক্ষে ভোট দেয়। ভোটদানে বিরত থাকে ভারত ও পাকিস্তান। কনভেনশনের বিরোধিতা করে তিনটি দেশ চীন, তুরস্ক ও বুরুন্ডি। কনভেনশনটি আইনে পরিণত করার জন্য ৩৫টি দেশের অনুস্বাক্ষর প্রয়োজন ছিল। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ভিয়েতনামের অনুস্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কনভেনশনটি আইনে পরিণত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ অজ্ঞাত কারণে আজ পর্যন্ত এ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি ছিল বলে মনে করেন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে নদী কমিশনের ভূমিকা অনেকটাই শিথিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ নানা কারণে তারা স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পায়নি। এছাড়া এ ধরনের বিষয় সমাধানে দুই দেশের পক্ষ থেকেই আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু ভারতের দিক থেকে তেমনটা পাওয়া যায়নি। তারা বাংলাদেশের সমস্যাগুলোকে এবং বাংলাদেশের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে এগোয়নি। ফলে গঙ্গা চুক্তির পর আমরা আর কোনো নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারিনি।’ তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনে সুরক্ষার কথা বলা আছে, কিন্তু বাংলাদেশ জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এ অনুস্বাক্ষর না করায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বাংলাদেশ যদি কনভেনশনে স্বাক্ষর করতো তাহলে ভারত উজানের দেশ হিসেবে চাইলেই ইচ্ছামতো পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারতো না। আর এমন কিছু করলেও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হতো ভারত।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টনের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি দুই দশের সুসম্পর্ক। যেখানে উভয় দেশই পরস্পরকে সম্মান করবে এবং ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকবে। এছাড়া এক্ষেত্রে আমাদের একটি বড় সহায়ক শক্তি হতে পারে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন। বাংলাদেশ যেহেতু ভাটির দেশ, আমরা এর মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবো। সিন্ধু চুক্তির ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক যেমনই হোক, তারা কিন্তু সেই চুক্তি মেনে চলছে। এর অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ কনভেনশন নদীবিষয়ক জটিলতা সমাধান করে দেবে। এর আগে আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়েও কিন্তু জটিলতা ছিল। সেটিও আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমাধান পেয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রেও তেমন। এখন যেমন তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে প্রায়ই জটিলতা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার উদ্যোগ নিলেও চুক্তি হচ্ছে না। তখন এমন সুযোগ থাকবে না।’
ভোরের আকাশ/ সু