logo
আপডেট : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:১৫
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার খড়গে ২৭ মন্ত্রী-এমপিসহ ৬০ ব্যক্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার খড়গে ২৭ মন্ত্রী-এমপিসহ ৬০ ব্যক্তি

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে ধীরে ধীরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়ছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা।

দুদকের জালে ধরা পড়ার আগেই কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন, আবার কেউ আটক হচ্ছেন বিভিন্ন সময়ে। অনেকেই আছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তবে যারা এখনও গ্রেপ্তার হননি সেই সব মন্ত্রী-এমপি কিংবা তাদের পরিবার যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেই উদ্যোগ নিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।

ইতোমধ্যে সাবেক ৮ মন্ত্রী ও ৬ সাবেক সংসদ সদস্যসহ বেশ কিছু ভিআইপির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ তালিকার মন্ত্রী-এমপি কিংবা আমলা এবং তাদের পরিবারের সদস্য যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সে কারণে ধাপে ধাপে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

প্রথম ধাপে ১৪ মন্ত্রী-এমপিকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আরও ২৭ জন মন্ত্রী ও এমপিদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ৬০ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেছে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। পৃথক পৃথক তিনটি আবেদনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যা আদালতের অনুমোদনক্রমে বাস্তবায়ন হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে একই দিনই সাবেক ৪১ মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনটি পৃথক টিম গঠন করে কমিশন। তিনজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত ওই টিম ইতোমধ্যে নথিপত্র তলব করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজন হেভিয়েট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ভিআইপিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সে কারণেই তাদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন রয়েছে।

তিনি বলেন, দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী-এমপিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে গ্রেপ্তার হোক বা না হোক আমাদের লক্ষ্য যাতে কেউই দেশত্যাগ করতে পারে। সে কারণে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। কমিশন অনুমোদন দিলেই তালিকা আদালতে পাঠানো হবে। আদালতে আদেশ দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে পাঠানো হবে।

দুদক উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম ১৩ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। ওই টিম সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, প্রাথমিক ও মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাবেক এমপি সরওয়ার জাহান, মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, যশোর-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ আফিল উদ্দীন, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক, জয়পুরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ও বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলালের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে গত সপ্তাহে কমিশনে আবেদন করেছেন।

অন্যদিকে দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে অপর একটি অনুসন্ধান টিম আরও ১৩ সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। এই টিম যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কমিশনে আবেদন করেছে তারা হলেন- সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, ধর্ম বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাসদ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ, যশোর-৩ আসনের সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, পটুয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি মহিববুর রহমান এবং নাটোর-১ আসনের সাবেক এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল।

আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মন্ত্রীর সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুসহ ১০ ব্যক্তির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কমিশন বরাবর আবেদন করেছে উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পৃথক আপর টিম। কমিশনের অনুমোদনক্রমে চলতি সপ্তাহে যা আদালত বরাবর পাঠানো হবে।

এর আগে ২৯ আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ থেকে ১৪ সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ওই ১৪ জন ভিআইপিদের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে দুদকের উপ-পরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের টিম কাজ করছে।

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া মন্ত্রীরা হলেন— সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান ও সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সংসদ সদস্যরা হলেন— সাবেক সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান।

আদালতে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, বিগত সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় এমপিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার এমপিদের দেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে পারেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

গত ১৫ বছরে মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে কারো আয় বেড়েছে, কারো বেড়েছে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০০ গুন থেকে কয়েক হাজার গুন। কারও ক্ষেত্রে সম্পদ ও আয় বেড়েছে লাখগুন পর্যন্ত। নির্বাচনী হলফনামার তথ্য নিয়ে টিআইবির করা এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই ৪১ সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এরপর ধাপে ধাপে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দের অর্থ লোপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা বিদেশে পাচারের অভিযোগ যুক্ত হতে থাকে তাদের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে বস্তায় বস্তায় টাকা আদায় করা অভিযোগ রয়েছে। তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে- জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতো এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিতো এই সিন্ডিকেট।

সর্বশেষ তথ্যানুসারে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলের নেতা, বিচারক, সরকারি আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৬২৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তারা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জান গেছে।

 

ভোরের আকাশ/মি