আমার বাবা একজন শিক্ষক। জন্মের পর থেকে মানুষের কাছে এটা ছিল আমার গৌরবের পরিচয়। বাবা ছিলেন একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল বাবার স্কুল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না বলে স্কুলেই থাকতেন। একটু বড় হতেই দেখতাম বাবা বাড়িতে এলে দাদা-দিদি বা পিসি-কাকা আমাদের ঘরে আসতো বই খাতা নিয়ে।
কারো ইংরেজি তো কারো অংক নিয়ে বসতো বাবার সামনে। আমি যখন বড় হতে থাকি আমার স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমরা তাঁদের প্রনাম করতাম। উৎসব ছাড়াও মাঝে মাঝে বাড়িতে শিক্ষকদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হতো। বাবা বাড়িতে আসলে গ্রামের হাইস্কুল বা প্রাইমারির শিক্ষকরা আসতেন। আমার বাবা দাবা খেলতে ভালবাসতেন। সেই হিসেবে গ্রামের অন্যান্য শিক্ষক বা বাবার ক্লাশমেট, বন্ধুরাও আমাদের বাড়িতে আসতেন দাবা খেলতে।
চারিদিকের এই শিক্ষক অপমানের চিত্র দেখে, একজন শিক্ষকের সন্তান হিসেবে নিজেকে বার বার অপমানিত লাগছে। আমার বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু শিক্ষকদের অপমানিত হতে দেখে বার বার আমার বাবার চেহারাটা ফুটে উঠছে। পিতা-মাতার পর শিক্ষকের স্থান। সেই পিতা-মাতা তুল্য শিক্ষকদের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নতজানু হয়ে। তোমরা ক্ষমা করে দিও।
আমি তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি। কোনো এক কাজে প্রাইমারি স্কুলের স্যার নিহার বাবু এসেছেন আমাদের বাড়িতে। সে সময়ে একটা প্রচলন ছিল কোনো স্যার বাড়িতে আসলে বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীরা দলবেধে প্রণাম করতাম। আমি সেদিন ঘরেই ছিলাম। স্যারকে ঢুকতে দেখে প্রণাম না করে পাশের ঘরে দিদিকে ডাকতে গিয়েছি। ভেবেছি দিদিকে ডেকে নিয়ে এসে একসাথে প্রণাম করবো। আমাকে ঘরে না দেখতে পেয়ে আমার মা আমাকে খুঁজতে বের হয়েছে। গিয়ে দেখে আমি দিদির কাছে দাঁড়িয়ে আছি।
কোনো কথা না বলে মা আমাকে লাঠি দিয়ে এমন মার মেরেছিল। আমিও তখন বুঝতে পারিনি মা কেন মারছে। আর দিদিও কিছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ছোট বেলায় আমি ভীষণ চিকন ছিলাম। আমার পিঠে যতগুলো লাঠির বাড়ি দিয়েছে প্রত্যেকটা ফুলে উঠেছে। তাতেও রেহাই নেই। মা আমাকে টানতে টানতে স্যারের পায়ের কাছে ফেলে বলছে, এক্ষুণি প্রণাম কর। আর মাপ চা, কেন বেয়াদবি করছিস। দিদি পেছনে পেছনে এসে মাকে বলছে, কাকীমা ও তো আমাকে ডাকতে গিয়েছিল স্যারকে প্রণাম করার জন্য। মা বললো, স্যারকে দেখে প্রণাম না করে চলে গেলো কেন? এটাই ছিল আমার অপরাধ।
কয়েকদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে কিছু ভিডিও দেখে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। উৎসব করে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের অপমান করছে। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষকে, সুযোগের অপব্যবহার করে সন্তান তুল্য, কেউ কেউ নাতি-নাতনি তুল্য ছাত্র-ছাত্রীরা যখন গায়ে হাত দিয়ে উল্লাস করতে করতে অপমান করে, তখন সচেতন মানুষ হিসেবে কেমন লাগে।
বিগত কয়েক বছর আমি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লেখালেখি করেছি। সুযোগ পেলে কথাও বলেছি। তৎকালীন সরকারের বড় বড় নেতা-আমলাদের সামনেও তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো যে মোটেই পরিচ্ছন্ন ছিল না তা আজ চোখে দেখছে জাতি। শুধু তা-ই নয় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
অন্যায়ের সাথে কখনোই আমি আপোস করিনি। তাইতো ক্ষমতার সংস্পর্শে থেকেও কখনো অন্যায়কে সমর্থন করিনি বা করতে পারিনি। সরকারি সুবিধা পাওয়ার আশায় কখনোই অন্যায় দেখে চুপ করে থাকতে পারিনি বলেই ছাত্রদের আন্দোলনে প্রথম থেকে সাথে ছিলাম। সমর্থন দিয়েছি সবসময়। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি অন্যায়ের আশ্রয় নেয় তাহলে তা কখনোই কাম্য নয়।
একজন শিক্ষক, তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন তাহলে তার শাস্তি কেন ছাত্র-ছাত্রীরা দিচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা-ব্যক্তি আর শিক্ষক কখনো সমতুল্য নয়। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি হয়। কিন্তু একজন শিক্ষক, অফিসিয়াল নিয়োগ প্রদান করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জানা উচিত নিজেদের অধিকার কতোদূর পর্যন্ত।
যারা ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক, তারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, যত ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত। তাদের বাবা-মা বা নিকট আত্মীয় বা দূরের আত্মীয় বা পরিচিত কেউ কি শিক্ষকতা করে না? অথবা শিক্ষা জীবনে একজনও কি প্রিয় শিক্ষক ছিল না?
আমি সবসময় একটি কথাই বলেছি, আজও বলছি। একটি সুস্থ সমাজ গড়তে একজন ভাল মা দরকার। একজন ভালো মা-ই কেবল পারে একটি সুস্থ সমাজ তৈরি করতে। কারণ একজন মা তার সন্তানের প্রথম শিক্ষক। সন্তানের নৈতিকতা, মানবিকতার ভিত্তি তৈরি করেন একজন মা। যদি কোনো মা মনে করেন আজকের ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা যা করছে তা ভালো করছে। তাহলে বলবো, আপনিও তৈরি থাকেন এই অন্যায়ের হাতটা কিন্তু একসময় আপনার দিকেও আসবে। কারণ পারিবারিক শিক্ষায় যে সন্তান শিক্ষিত হয় সেই সন্তান কখনো সম্মানীয় ব্যক্তিকে অসম্মান করতে পারে না। আপনি নিজ সন্তানের মধ্যে যে বিষবৃক্ষ রোপণ করছেন তার ফল আপনাকেও ভোগ করতে হবে।
দেশজুড়ে যে পদত্যাগের উৎসব শুরু হয়েছে তাতে কেবল অপমানিত হচ্ছেন শিক্ষকরা। কেন এই অনৈকিতকা? এর যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনি। একজন পুলিশের আইজিকে এভাবে অপমানিত করে পদত্যাগ করাতে পারেনি কেন শিক্ষার্থীরা? কেন একজন সচিব-উপসচিবকে পদত্যাগের সময় তার কলার চেপে ধরতে পারেনি? দেশের সবচেয়ে আলোচিত পুলিশ অফিসার, যার জন্য দেশের কতো নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। তাকে পদত্যাগের সময় কেন এমন অশোভন উল্লাস করতে পারেনি? শুধু শিক্ষকদের বেলায় কেন? শিক্ষকদের উপর এত ক্ষোভ কেন তাঁদের?
অধিকাংশ সময় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষকদের বলাৎকার বীভৎস ঘটনা। চলতি উৎসবের মরশুমে কোনো মাদ্রাসার শিক্ষককের পদত্যাগের কোন ঘটনা ঘটেনি। এমন কোন তথ্য বা নিউজ আমার জানা নাই। তাহলে কি বলবো, মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ভালো শুধুমাত্র সাধারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা খারাপ। অথবা আমি ধরেই নেবো মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অনেক শোভন। তারা শিক্ষকের সঙ্গে এমন অশোভন আচরণ করতেই পারে না। দেশে অনেক অধিদপ্তর রয়েছে তার প্রধানদের পরিবর্তন হয়েছে। এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার কোথাও কি কোনো পদত্যাগের উৎসব হয়েছে, হয়নি। তাহলে নির্দিষ্ট করে শুধু সাধারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমনটি হচ্ছে কেন?
ইতিহাস বলে, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আঘাত করতে হয়। শিক্ষকদের নিয়ে এই যে ‘পদত্যাগ তামাশা’ দেখে আমার মনে হচ্ছে এটি কোনো যড়যন্ত্র। এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সুকৌশলে শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থী আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকায় ছিলেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আসিফ নজরুল। তিনি নিজে একজন শিক্ষক হয়ে এধরনের অন্যায় কি করে মেনে নিচ্ছেন আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
দল-মত নির্বিশেষে একটাই কথা বলবো। আজকে যে শিশুটি বেড়ে উঠছে তার সামনে ভাল কোনো উদাহরণ থাকছে না। যদি বলি পনের বছর অন্যায়ের চাষ হয়েছে। তবুও বলবো যদি সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আরো অনেকগুলো অন্যায়ের জন্ম হয় তাহলে তো সেই হলো, ‘পুনর মুশিক্ ভবঃ’। আমরা তো অন্যায় কে প্রতিহত করে একটি সুন্দর আগামীর জন্য আন্দোলনের সমর্থন করেছি। মনের কোনে সুপ্ত বাসনা ছিল অন্যায়ের রাজত্ব শেষে একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের মুখ দেখবো। কিন্তু শিক্ষকদের অপমান করার সংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে? তাদের সামনে কি কোন ব্যারিকেড আছে, নাকি খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে!
ধরেই নিলাম শিক্ষকগণ খুবই খারাপ। বিগত সরকারের নিয়োগ প্রাপ্ত। অথবা বর্তমান সময়ে যারা ক্ষমতায় আসীন বা হতেচ্ছু, তাদের পছন্দের শিক্ষকদের সেখানে নিয়োগ দিবেন। তাতে কোনো আপত্তি নেই। পদত্যাগ যদি বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে তো বেশ। সে জন্য তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন। অফিসিয়ালী কাগজে কলমে পদত্যাগের অর্ডার দিতে পারতো। শিক্ষকদের নিয়োগ কিন্তু কোনো জনগণ দেন না। এর জন্য রয়েছে একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামো। সেই অনুযায়ী তাঁরা নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং প্রমোশন-ডিমোশন বা চাকরিচ্যুৎ হন।
তবে হ্যা, কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে পারে। কিন্তু গায়ের উপর পড়ে টেনে- হিঁচড়ে, কিল-ঘুষি দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী একটি ভিডিওতে দেখলাম বলছে, ‘অমুক শিক্ষককে একটা চড় দিতে পেরেছি, এ জন্য খুশি লাগছে।’ এটা কি ধরনের নৈতিকতা! শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। এই রকম পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে যে শিশু বেড়ে ওঠে, সে ভবিষ্যতে হয়তো অনেক লেখাপড়া করতে পারে, তবে শিক্ষিত মানুষ হতে পারে না। একজন আদর্শবান শিক্ষিত মানুষ একটি দেশের সম্পদ।
চারিদিকের এই শিক্ষক অপমানের চিত্র দেখে, একজন শিক্ষকের সন্তান হিসেবে নিজেকে বার বার অপমানিত লাগছে। আমার বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু শিক্ষকদের অপমানিত হতে দেখে বার বার আমার বাবার চেহারাটা ফুটে উঠছে। পিতা-মাতার পর শিক্ষকের স্থান। সেই পিতা-মাতা তুল্য শিক্ষকদের কাছে বারবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নতজানু হয়ে। তোমরা ক্ষমা করে দিও।
লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক
ভোরের আকাশ/মি