মোবারক হোসেন-রহিমা খাতুন দম্পতি তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা সাত দিন বয়সী ছেলে শিশুকে নিয়ে সকাল থেকে রাজধানীর হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেন নি। রোববার বিকেল সাড়ে তিনটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চত্ত্বরে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন রহিমা। শুধু একটা কথাই তার মুখ থেকে বের হচ্ছিল-এখন কী করব আমি? কোথায় যাব? আমার সন্তান কী চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাবে? পাশে দাড়িয়ে থাকা তার স্বামী মোবারক হোসেন জানালেন, শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা সন্তানকে নিয়ে প্রথমে সকাল সাড়ে আটটার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে কোনো চিকিৎসা না দিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জানানো হয়, ধর্মঘট চলছে। কোনো চিকিৎসা দেওয়া হবে না। এরপর সেখান থেকে একে একে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং সবশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেও চিকিৎসা মেলেনি ছোট্ট শিশুটির।
চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রোববার দিনভর চিকিৎসক ধর্মঘটে এভাবেই অবর্ননীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছে শত শত রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে ভিড় করছেন রোগী ও স্বজনরা। তবে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন নি। প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালন করা আনসার ও কর্মচারীরা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এমন অবস্থায় রোগীর অনেক স্বজনরাই জড়াচ্ছেন বাদানুবাদে। তবে শেষ পর্যন্ত তাদেও প্রধান ফটক থেকে ফেরত যেতে হচ্ছে। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী ও স্বজন।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ওয়ার্ডে বসে হাউ মাউ করে কাঁদছেন বিজয় গাইন(২৭)। কেবিনে তার বাবা বিমল গাইন (৬২) সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন। বিজয় গাইন বলেন, শনিবার রাতে সড়ক দুঘটনায় তার বাবা মারাত্নকভাবে আহত হয়। রাতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হলেও সকাল থেকে কোন ডাক্তার তার বাবাকে দেখছেন না বলে অভিযোগ তার।
মো.আজিজ পুরান ঢাকার বাসিন্দা। মায়ের চিকিৎসার জন্য সকাল সকাল এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকদের শাটডাউন কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না তাদের। ফলে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও পেলেন না চিকিৎসাসেবা।
রোববার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় আজিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, মায়ের চিকিৎসার জন্য সকালে ঢামেকে এসেছি। কিন্তু এসে শুনি ডাক্তার নাই। ভাবলাম অপেক্ষা করি ডাক্তার হয়ত আসবে। কিন্তু বিকেল ৩টা বেজে গেলেও ডাক্তার আসেনি।
তিনি বলেন, ভেতরের স্টাফরা পরে জানাল আজ আর ডাক্তার আসবেন না। তাহলে এই কথাটা তারা আগে কেন বলতে পারল না। সারাটা দিন অপেক্ষা করে তো আমার মায়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে, এর দায়ভার কে নেবে।
কল্যানপুর থেকে চিকিৎসা নিতে ঢামেকে এসেছিলেন সাত মাসের গর্ভবতী মুক্তা আক্তার। হঠাৎ পেটে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন তিনি। তাই দ্রুত স্বজনরা তাকে ঢামেকে নিয়ে আসেন। কিন্তু চিকিৎসকদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। একদিন অপেক্ষা করেও চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা।
মুক্তার স্বজনরা বলেন, শনিবার রাতে আমরা তাকে নিয়ে ঢামেকে আসি। সকাল থেকে চিকিৎসা পাইনি। আজ দিনের প্রায় শেষ, কোনো চিকিৎসার খবর নেই। এদিকে রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
তারা আরও বলেন, এখন প্রাইভেট মেডিকেলে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যদি সেখানেও চিকিৎসা না পাওয়া যায়, তাহলে কি করব জানি না।
নোয়াখালী থেকে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, সকাল ১০টা থেকে এখন পর্যন্ত বসে আছি। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিটও দিচ্ছে না। আমাদের দোষ কোথায়, আমরা কেন সেবা পাব না। আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি বা আমরা ডাক্তারদের ওপর হামলা করিনি। তাহলে আমরা কেন চিকিৎসা পাব না?
খুলনা থেকে এক বৃদ্ধ রোগীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা স্বজন বলেন, সকালে দেয়াল চাপা পড়ে আমার নানা আহত হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে শুনি এখানে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছে। তার অবস্থা ভালো না, গাড়িতে অক্সিজেন দিয়ে রেখেছি। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে দাঁড়িয়ে আছি, জানি না আমার নাতিকে বাঁচাতে পারব কি না।
এর আগে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, দোষীদের গ্রেপ্তার ও সেনাবাহিনী মোতায়েন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশের সব হাসপাতালে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করা হয়। হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আব্দুল আহাদ এ ঘোষণা দেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন শনিবার থেকে ঢামেকে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আমাদের তিনজন চিকিৎসককে নিউরো সার্জারি বিভাগ থেকে মারতে মারতে প্রশাসনিক ব্লকের পরিচালকের রুমে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই বহিরাগতরা এসে হাসপাতালে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এরপর ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি সেন্টারে (ওসেক) এসে ভাঙচুর চালায়। এরকম ঘটনা যদি প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা সেবা দেব। কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহতদের আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। যেখানে আমাদের নিরাপত্তা নেই, সেখানে আমরা কীভাবে চিকিৎসা দেব।
শনিবার নিউরো সার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেন চিকিৎসকরা। অন্যথায় আজ সোমবার রাত আটটার পর তারা আবারও কর্মবিরতিতে যাবেন বলে ঘোষণা দেন।
ভোরের আকাশ/ সু