logo
আপডেট : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:৩৯
১২৬তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা সাহিত্যিক সাংবাদিক রাজনীতিক আবুল মনসুর
খান মো. রবিউল আলম

১২৬তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা
সাহিত্যিক সাংবাদিক রাজনীতিক আবুল মনসুর

আজ ৩ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৮৯৮ সালের এদিনে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ৮০ বছর বয়সে মারা যান। এ বছর আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার ১০১ বছর পূর্ণ হলো। তিনি ১৯২৩ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’-এ যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। উল্লেখ্য, তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে গবেষণা কর্মের জন্য ৫ জনকে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। তারা হলেনÑ ড. রাজীব হুমায়ূন, ড. নুরুল আমিন, ড. মিজানুর রহমান, ড. মো. চেঙ্গীশ খান ও ইমরান মাহফুজ। বিশেষ সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়েছে এমিরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে।

তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক। তিনি ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক ছিলেন এবং তৎকালীন ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কাজ করেন। আবুল মনসুর আহমদ দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘ইত্তেহাদ’ দাঁড় করান। তিনি ‘ইত্তেহাদ’-এ সাংবাদিকদের হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। প্রতিদিন সম্পাদকীয় টেবিলে আলাপ-আলোচনা, পাঠক মজলিশ, হেডলাইন, ডিসপ্লে, মেকআপ, গেটআপ, টাইপ বিতরণ, প্রুফ রিডিংয়ের ফলে ‘ইত্তেহাদ’ অতিদ্রুত কলকাতায় শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় দৈনিকে পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যদের ভোটে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

আবুল মনসুর ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৬-৫৭ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। এর কয়েক বছর পর তিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন।

আবুল মনসুর আহমদের রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক বই ‘আয়না’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘গালিভারের সফরনামা’ ও ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘বাংলাদেশের কালচার’ ইত্যাদি। তার আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ‘আত্মকথা’ ও ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’।

আবুল মনসুর আহমদ ওজস্বী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ওজস্বিতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা আর বুদ্ধি বা যুক্তি তার সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য। তার লেখায় রয়েছে প্রাঞ্জলতা, মাধুর্য আর যুক্তির বিন্যাস। আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতার এক অনন্য শেরপা। আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতার হাতেখড়ি পর্যায় পেরিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৩৮ সালে দৈনিক ‘কৃষক’-এ প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ‘কৃষক’ চালাতে গিয়ে একপর্যায়ে অর্থাভাবে পড়েন। ‘কৃষক’-এ তিনি সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা, সংবাদশিল্পী, সংবাদ-বাণিজ্যÑ সব দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন।

আবুল মনসুর আহমদ গ্রহণোন্মুখ ব্যক্তিত্ব। সহকর্মী, জ্যেষ্ঠ ও অনুজ ব্যক্তিদের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা-চেতনা শাণিত করেছেন। তিনি সংস্কারমুক্ত ছিলেন, ছিলেন খোলামনের অধিকারী। যুক্তির পরাকাষ্ঠে সবকিছু যাচাই করতেন। আবুল মনসুর আহমদ গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর অনুজদের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষে তিনি গুরু-চ্যালাপরম্পরা চর্চা করতেন।

আবুল মনসুর আহমদ কলাম লিখতেন, সংবাদ ব্যবস্থাপনা-সম্পাদনা করতেন, শিরোনাম লিখতেন, সংবাদের ট্রিটমেন্ট ও মেকআপ দেখতেন। তিনি কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানদের সঙ্গে থেকে কাজ করতেন। এ সময় তিনি লক্ষ করেন, ‘সাংবাদিকতায় জ্যেষ্ঠরা অনুজদের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পছন্দ করেন।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘জুনিয়র স্তরের এ খাটুনি তার জীবনে খুব কাজে লেগেছিল।’আবুল মনসুর আহমদ কপি এডিট করতে খুব পছন্দ করতেন।

আবুল মনসুর আহমদ যেসব সংবাদপত্রে কাজ করেছেন, সেখানে সম্পাদকীয় বিভাগকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ‘মোহম্মদী’তে ‘রক্তচক্ষু’ ‘বজ্রমুষ্টি’ ও ‘সিংহনিনাদ’ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে দায়িত্ব পালনকালে তিনি অর্থসংকট, মালিকের বৈরী আচরণ, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শিকার হন। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। আবুল মনসুর আহমদের শিক্ষা হলো যেকোনো বৈরী পরিস্থিতিতে সম্পাদনা পর্ষদকে পেশাগত উৎকর্ষ ধরে রাখতে হবে, অবিচল থাকতে হবে। সংকটে নিজেকে চিনে নিতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে আপন গন্তব্যে।

আবুল মনসুর আহমদ তার জীবদ্দশায় সংবাদপত্র প্রকাশনা যে শিল্পে পরিণত হতে যাচ্ছে, তা লক্ষ করেন। তিনি লেখেন, ‘১৯৪৭ সালে সাংবাদিকতা হইয়া উঠিয়াছিল একটি পূর্ণমাত্রার ইন্ডাস্ট্রি। সাহিত্য শাখা, মহিলা শাখা, শিশু শাখা, সিনেমা শাখা, নগর পরিক্রমা ও খেলাধুলা ইত্যাদি বিভিন্ন ফিচার দিয়া আজকাল দৈনিক খবরের কাগজকে রীতিমতো আকর্ষণীয় পঠিতব্য সাহিত্য করিয়া তোলা হইয়াছে। সকল বিভাগের পৃথক-পৃথক সম্পাদক আছেন। কাজেই দৈনিক সংবাদপত্রের আর এখন একজন মাত্র সম্পাদক নাই, বহু-সংখ্যক সম্পাদক হইয়াছেন।’

মূলত সার্কুলেশনের কারণে ‘ইত্তেহাদ’-এর শক্র বেড়ে যায়। পূর্ব বাংলার সরকার ‘ইত্তেহাদ’ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করলে ১৯৫০ সালে তার অপমৃত্যু ঘটে। এরপর আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি কাগজে কলাম লিখে সাংবাদিকতা চালিয়ে নেন। আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মকথায় সাংবাদিকতা জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সাতটি বর্গে ভাগ করেছেন, সেগুলো হলো

১. সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে। ২. সাংবাদিকতার সঙ্গে রাজনীতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টিগত শ্রেণিগত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এ মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব। ৩. বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটূক্তি না করিয়াও তার তীব্র সমালোচনা করা যাইতে পারে ভদ্রভাষায়। বস্তুত সমালোচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালোচনা তত তীক্ষè ও ফলবতী হবে। ৪. প্রতিটি মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলোচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য। ৫. মরহুম মৌলভি মুজিবর রহমান বলিতেন : সংবাদপত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলামটাই সম্পাদকের; বাকি সবটুকুই পাবলিকের। চিঠিপত্র কলামটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয়। অতএব, সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দাপূর্ণ পত্রও চিঠিপত্র কলামে ছাপিতে হইবে। ৬. সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভাব হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে। ৭. বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন : ছাপার মেশিনের মতো সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মতো প্রেসইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেসইঞ্জিনে দরকার ইন্টেলেকচুয়াল ইউনিটি। আবুল মনসুর আহমদ উল্লেখ করেন, এই সাতটি দফা ছিল তার জন্য সাংবাদিকতার ক, খ। তার অনুসৃত দফাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক ও অনুসরণযোগ্য। আবুল মনসুর আহমদের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

 

ভোরের আকাশ/মি