logo
আপডেট : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:০৪
পোশাকশিল্পে কালো ছায়া ,ক্ষোভে ফুঁসছেন শ্রমিকরা
শফিকুল ইসলাম

পোশাকশিল্পে কালো ছায়া ,ক্ষোভে ফুঁসছেন শ্রমিকরা

  • শ্রীপুরে ভারতীয়দের চাকরিচ্যুতি দাবিতে বিক্ষোভ
  • আশুলিয়ায় ৬০ কারখানায় ছুটি
  • বিশৃঙ্খলাকারীরা বহিরাগত : স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
  • টাকা দিয়ে আন্দোলন করানো হচ্ছে : শ্রম উপদেষ্টা


কয়েক দিন ধরেই গাজীপুর ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন তারা। গতকাল বুধবার গাজীপুরের শ্রীপুরে আর এ কে সিরামিক কারখানার শ্রমিকরা ভারতীয় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতিসহ ৯ দফা দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ৬০ পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে হুঁশিয়ারি দিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, শিল্পাঞ্চলে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলকারীরা বহিরাগত। এদিকে টাকা দিয়ে আন্দোলন করানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।

গতকাল শ্রীপুর উপজেলার নয়নপুর এলাকায় আর এ কে সিরামিক কারখানার সামনে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা শ্রমিকরা মহাসড়কে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেন। পরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের প্রস্তাব দিলে তারা মহাসড়ক থেকে সরে যায়।

শ্রমিকদের দাবিগুলো হলোÑ কারখানার নিয়মনীতির পরিবর্তন ও সংশোধন নোটিশের মাধ্যমে করতে হবে; প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মানসম্মত বেতন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে; চলতি বছরের বেতন বৃদ্ধি আজকের (৪ সেপ্টেম্বর) মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে; কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিক থেকে ম্যানেজমেন্ট-স্টাফ পর্যন্ত সকল ভারতীয়দের অপসারণ করতে হবে; জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এরিয়া বিল দিতে হবে; দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে জড়িত শ্রমিকদের হাজিরা নিশ্চিত করতে হবে; নতুন এবং পুরাতন বেতন কাঠামো সঠিকভাবে প্রণয়ন করতে হবে; সিভিল কর্মীদের সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা হাজিরা দিতে হবে; হাজিরা বোনাস ১৫০০ টাকা করতে হবে; আন্দোলনের পরে কর্মস্থলে যোগদানের পর কোনো কর্মীকে অযথা হয়রানি, বহিষ্কার ও চাকরিচ্যুত করা যাবে না। হয়রানি, বহিষ্কার ও চাকরিচ্যুতি করলে পুনরায় শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য হবে।

আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, জানুয়ারি মাসে বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি করলেও ওই বেতন না দিয়ে আগের গেজেট অনুযায়ী বেতন পরিশোধ করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ সময় ইনক্রিমেন্ট আকারে বেতন পরিশোধের দাবি জানান তারা।

গাজীপুর শিল্পপুলিশের পরিদর্শক রাহয়ান মিয়া জানান, আর এ কে সিরামিক কারখানার শ্রমিকরা ৯ দফা দাবিতে সকাল ৬টা থেকে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শ্রমিকরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

এসব বিষয়ে আর এ কে সিরামিকস কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করলে এ বিষয়ে তারা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

সাভারে ৬০ কারখানায় ছুটি : গতকাল সকালে নির্ধারিত সময়ে আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় কাজে যোগ দেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে বন্ধ ঘোষণা করা কারখানার শ্রমিকেরা চালু থাকা বিভিন্ন কারখানার সামনে এসে বিক্ষোভ করেন। কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তারা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশীরাও যোগ দেন। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলো ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা পরে সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশের সদস্যরা তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেন।

নরসিংহপুর এলাকায় হা-মীম গ্রপের কারখানার পাশে প্রত্যক্ষদর্শী এক চায়ের দোকানদার বলেন, সকাল থেকে কারখানায় কাজ চলছিল। পরে চাকরির জন্য লোকজন কারখানার সামনে এসে বিক্ষোভ করলে কারখানা ছুটি দিয়ে দেয়। এ দিকে সকাল ১০টার দিকে পলাশবাড়ী এলাকার পার্ল গার্মেন্টস কোম্পানি লিমিটেডের সামনে টিফিন ভাতা, হাজিরা বোনাস ৮০০ টাকা করা, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা।

এদিকে কিছু কারখানার শ্রমিকেরা কারখানায় হামলা ঠেকাতে কারখানার সামনে অবস্থান নিয়েছেন। পলাশবাড়ী এলাকার গিল্ডান বাংলাদেশ নামের পোশাক কারখানার সামনে কারখানায় হামলা ঠেকাতে অবস্থান নিয়েছেন ওই কারখানার শ্রমিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কারখানার এক শ্রমিক বলেন, আমরা কাজ করতে চাই। কারখানা আমাদের সম্পদ। তাই এটা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কারখানা বন্ধ হলে খাব কী?

আশুলিয়ায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকরা কারখানায় আসেন। পরে বিভিন্ন কারখানার সামনে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা হা-মীম গ্রুপের কারখানার শ্রমিকদের দেখে তারা কেন কারখানায় কাজ করছেন, এমনটি বলার পর কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে আশুলিয়ার অন্তত ৬০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ। এই মুহূর্তে ওই এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।

বিশৃঙ্খলকারীরা বহিরাগত : স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, শিল্পাঞ্চল এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের নামে যারা বিশৃঙ্খলা করছেন, তারা শ্রমিক নন, বহিরাগত। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অফিসকক্ষে এক বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে গাজীপুর ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ‘শ্রমিক আন্দোলন’ নিয়ে বৈঠক করেন কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, আজকের বৈঠকটা হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে। আমাদের কথা হচ্ছে প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা অন্তত নিজের বাড়ি (কর্মস্থল) পোড়াবে না। শ্রমিকরাই বলেছেন, প্রকৃত শ্রমিকরা এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। কারণ এটা তাদের জীবিকা। তিনি বলেন, আপনারা দেখবেন যেগুলো আমাদের ভাইব্রেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, যেমনÑ প্রাণ কোম্পানিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে তো কখনও শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে ফরেন কারেন্সি আসা বন্ধ হয়ে যাবে। লোকাল ইন্ডাস্ট্রি নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে কার লাভ হবে? এসব বিষয় চিন্তা করেই আমাদের এগোতে হচ্ছে। শ্রমিকরা এখানে কোনো ডিস্টার্ব করছে না। যারা করছে, তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। এসব বহিরাগতকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে জন্য হয়তো আমাদের একটু কঠোর হতে হবে, শক্ত হতে হবে।

বর্তমান সরকার এ কয়েকদিনে নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ফোর্স ব্যবহার করেনি, করবেও না জানিয়ে তিনি বলেন, এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আমার ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে গেলে, শ্রমিককে বাঁচাতে গেলে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে গেলে, কিছু সংখ্যক এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ব্যাপারেই আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, কীভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। সে পদক্ষেপগুলো কী, সেটা আপনারা আগামীতে দেখতে পাবেন।

পুলিশ যাতে সাধারণ মানুষের হাতে নিবৃত্ত না হয়, সেই পদক্ষেপ পুলিশকেই নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বিগত দিনে অপকর্মের পর অপকর্মের কারণে পুলিশের যে মনোবল নষ্ট হয়েছে, সেটা তো একটা ট্যাবলেট খাওয়ালেই ঠিক হবে না। এখানে সবার সহযোগিতা দরকার। এটা তাদের হারানো জিনিস, তাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা তাদের আশ্বাস দিতে পারবো, কিন্তু মূল কাজটা নির্ভর করছে তাদের নিজেদের ওপর। তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া বলেন, এ আন্দোলনে শ্রমিকদের দেখা যাচ্ছে না, তবে টাকা দিয়ে যাদের এসব আন্দোলনে নিয়ে আসা হয়; সে সব টোকাইদের দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকদের কিছু দাবি আছে, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি। যেমন- বেতন বাড়ানো, শ্রম আইন সংশোধন। এগুলো তো একদিনে করা যাবে না। তারপরও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, তারা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

তিনি বলেন, আমরা বলেছি, যারা বহিরাগত তাদের আলাদা করেন। শ্রমিকদের আলাদা করেন। যারা ছোট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাস করছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা যেসব সিন্ডিকেট চালাতো, তারা সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা দখলের চেষ্টা করছে এবং বহিরাগত যারা শৃঙ্খলার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভোরের আকাশ/ সু