logo
আপডেট : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:২০
শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক মাস
কোথায় দাঁড়িয়ে দেশ, কী পরিবর্তন এলো
নিখিল মানখিন

কোথায় দাঁড়িয়ে দেশ, কী পরিবর্তন এলো

  • গ্রেফতার এক ডজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি, দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞায় অন্যরা
  • শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা
  • মামলার জালে আ. লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন
  • অনিশ্চয়তার আতঙ্ক জনমনে



আজ ৫ সেপ্টেম্বর। গত আগস্টের আজকের দিনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের তিন দিনের মাথায় নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাসে কোথায় দাঁড়িয়ে দেশ, কী পরিবর্তন এলো-এমন প্রশ্নের উত্তর জানার আগে মোট দাগে যে বিষয়গুলো সামনে আসবে তা হল- ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও হয়নি। মুছে যায়নি ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার স্থাপনাসমূহের ক্ষত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থাহীনতায় ভুগছে শিক্ষাঙ্গন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জনসাধারণের সৃষ্ট দূরত্ব কাটেনি। পুলিশ কাজে ফিরলেও গাছাড়া ভাব কাটেনি। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে পরিবর্তন আনা হয়েছে সর্বোচ্চ বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসনের শীর্ষ পদ, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়াত্ত বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তরের শীর্ষ পদে আগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে যারা সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে বঞ্চিতদের মধ্য থেকে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এর মধ্যেই সরকারি কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে সরব। আনসার বাহিনীর কিছু সদস্য ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষেও ঘটনা উত্তাপ ছড়িয়েছে। গত মঙ্গলবার সেনাবাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছে। কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা হচ্ছে। এর মধ্যেই গতকাল বুধবার থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। সরকার পতনের এক মাস পূর্ণ হওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার ‘শহীদি মার্চ’ পালনের ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাসেও অস্থিরতা কাটেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি দেশ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ১৯৭৫, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে দেশে সরকারের পতন ও পরিবর্তনের পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলেও তা এতোটা দীর্ঘ ছিল না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন সরকারবিহীন দেশে জীবন ও সম্পদের নিশ্চয়তার খোঁজে ছিল মানুষ। ভাঙচুর, লুটপাট, ডাকাতি ও হানাহানি ঘটনা ঘটেছে রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে এমন অরাজক পরিস্থিতি মানুষ আর প্রত্যক্ষ করেনি। দেশ এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। কবে নাগাদ স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে তাও অজানা। তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না ফেরা পর্যন্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না বলে মনে করেন তারা।

ক্ষমতা ছাড়ার পর অভ্যুত্থানকারী জনতার হাতে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার হিসাবও পাওয়া যায়নি। কারণ, শেখ হাসিনার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই আগে থেকে শক্তি হারানো দেশের অনেক থানা ত্যাগ করে পালিয়ে যায় পুলিশ। অনেক স্থানে পুলিশকে ভেতরে রেখেই তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। এসব ঘটনার পর দেশে সরকার না থাকার পাশাপাশি সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিও উধাও হয়ে যায়। পুলিশ ছিল না, চলে বেশুমার হামলা, ডাকাতি। দেশের সর্বত্র সৃষ্টি হয় অরাজকতা। যা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বঙ্গভবনে গত ৮ আগস্ট রাতে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যস্ত সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ অনেক পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে সর্বোচ্চ বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসনের শীর্ষ পদ, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়াত্ত বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তরের শীর্ষ পদে আগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে যারা সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে বঞ্চিতদের মধ্য থেকে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে গণ মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এ রহমান, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দিপু মনি, বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ এক ডজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি। অন্যরা পলাতক। অনেকের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সহযোগী ১৪ দলীয় জোটের দুই শীর্ষ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন গ্রেফতার হয়েছেন। জোটের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে গ্রেফতারের পর জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের সাবেক দুই প্রধান শহীদুল হক ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও গ্রেফতার হয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সব সেক্টরেই রদ বদল ও নিয়োগ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ফিরে আসেনি সরকারের অস্থির প্রশাসনে। এই অস্থিরতার পরিধি সচিবালয় থেকে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। বদলি ও পদোন্নতি নিতে দৌড়ঝাপ চলছে পদবঞ্চিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। এতে আতঙ্কে বিদায়ী সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কর্মস্থলে যাচ্ছেন না তাদের অনেকে। সব মিলিয়ে প্রশাসনে ফিরে আসেনি শৃঙ্খলা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও ভাঙচুর। সরকারবিহীন তিন দিনেই ঘটে যায় অনেক বীভৎস্য ও লোমহর্ষক ঘটনা। দখলদারিত্বের বড় অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। যদিও বেশ কয়েকটি ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে বিএনপি।

ছাত্র আন্দোলনকেন্দ্রিক হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতা ও পুলিশবাহিনীর মধ্যে সন্দেহ ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। অসংখ্য থানায় হামলার ঘটনা ও পুলিশ সদস্যদের হত্যার অভিযোগ উঠে। হাজার হাজার অস্ত্র লুটপাতের ঘটনা ঘটে। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। কর্মস্থলে যোগদানের অস্বীকৃতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে তারা। পরবর্তীতে কর্মস্থলে ফিরে গেলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন পুলিশ সদস্যরা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছেন না তারা।

এদিকে আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার নিহত হওয়ার জন্য পুলিশ সদস্যদের দায়ী করছে বৈষম্য ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা সংযত আচরণ করলে আন্দোলনকারীদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটতো না। যার প্রমাণ মিলেছে আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানের সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিছু ভিডিও চিত্রে। এভাবে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

মামলা-হামলায় আক্রান্ত আওয়ামী লীগ। আত্মগোপনেই রয়ে গেছেন দলটির সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতারা। রাজনৈতিক কর্মসূচি তো দূরের কথা, বাসাবাড়ি থেকে বের হওয়ার পরিস্থিতি নেই দলটির নেতাকর্মীদের।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকরা ছাড়া অন্য সব দল রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় রয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান ও কর্মসূচি বেশ দৃশ্যমান। তবে সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যেই প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। সংস্কার কাজের জন্য সরকারকে বেশি সময় দেয়ার ব্যাপারে নমনীয় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী। আর নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

শিক্ষাঙ্গনে বিরাজ করছে অস্থির পরিবেশ। শিক্ষকদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করানো এবং অপমান ও অপদস্থ করার ঘটনায় বিব্রত দেশবাসী। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পরস্পরকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছে তারা। আর এমন পরিস্থিতিতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ।

রাজধানী ঢাকা যেন অগণিত সংগঠনের দাবি আদায়ের নগরীতে পরিণত হয়েছে। একই সময়ে বির্ভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য মাঠে নেমেছে বিভিন্ন সংগঠন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও রাস্তায় অবস্থান নিয়ে তারা সৃষ্টি করছে তীব্র যানজট। সচিবালয়ের ভেতরে আন্দোলনকারীদের জোর করে প্রবেশের ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীদের পর আনসার সদস্যরা সচিবালয়ের ভেতরে জোর করে প্রবেশ করে গোলমাল সৃষ্টি করেন। প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় বাসভবনের সামনেও বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ।

ভোরের আকাশ/ সু