logo
আপডেট : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:২৪
এত আ.লীগ গেল কোথায়
নিখিল মানখিন

এত আ.লীগ গেল কোথায়

  • প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি নেই
  • অনলাইনে কিছুটা সক্রিয়
  • সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের অনেকে পালিয়ে বিদেশে
  • অনেকে আত্মগোপনে
  • শীর্ষ অনেক নেতা কারাগারে

 


‘১৫ আগস্ট, ৩২ নম্বর ওই ধানমণ্ডিতে লাশগুলো তো পড়েছিল। কত সেøাগান- বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে আমরা আছি সেখানে। এ ছাড়াও কত সেøাগানই তো ছিল। সেই সঙ্কট মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু দলের অনেক নেতাকে ফোন করেছিলেন। কী করেছিলেন তারা? কোথায় ছিল সে মানুষগুলো, একটি মানুষ ছিল না সাহস করে কথা বলার, একটা মানুষ ছিল না প্রতিবাদ করার। কোথায় ছিলেন আওয়ামী লীগের এত বড় বড় নেতা। বেঁচে থাকলে সবাই থাকে, মরে গেলে কেউ থাকে না, এটাই তার জীবন্ত প্রমাণ। আর সে জন্য আমিও কিছু আশা করি না।’ ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের ওপর এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আজ থেকে দুই বছর আগে শেখ হাসিনার বক্তব্যের বাস্তবতা মিলে গেল আরও একবার। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক ৪৯ বছরের মাথায় এসে একই পরিস্থিতিতে পড়েছে দলটি। পঁচাত্তরের সংকট কাটিয়ে উঠে দলটি ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যায়। এরপর আবারও বিরোধী দলে থাকার পর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর টানা তিন মেয়াদ পূর্ণ করে চতুর্থ মেয়াদে এসে হোঁচট খেল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এর মধ্য দিয়ে দলটি টানা ১৬ বছরের শাসনামলের ইতি ঘটে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এই সংকট কাটিয়ে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবেÑ এ প্রশ্ন সবার।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আর মাঠে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। দলের লাখ লাখ সক্রিয় নেতাকর্মী যেন মুহূর্তের মধ্যেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন! মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির এমন করুণ অবস্থা মেনে নিতে পারছে না দলের তৃণমূলের কর্মীরা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ হাসিনার সংসদীয় এলাকা গোপালগঞ্জে কয়েকদিন মিছিল সমাবেশ হলেও সেখানকার নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর থেকে তারাও গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। এর বাইরে বরগুনায় দুই দিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। সেখানকার আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর বাইরে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কোনো নেতাই মাঠে নেই। এমনকি কর্মীদেরও খোঁজ মিলছে না। অনেকে পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একমাস পরও আতঙ্ক কাটেনি দলটির নেতাকর্মীদের। সরকার পতনের পরপরই রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দলীয় সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবন। বাদ যায়নি ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনও; যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের অধিকাংশ দলীয় নেতা নানাভাবে আক্রান্তের র্শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশ দলীয় নেতা ও এমপি দেশে অবস্থান করলেও বাসা-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থান বেছে নিয়েছেন। এবার শুরু হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণ মামলা। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখনো খোঁজ মিলছে না আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও প্রতাপশালী সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের। দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, সরকার পতন হওয়ার বিষয়টি চিন্তাও করতে পারেননি তারা। গণজাগরণ ও বিরোধীদের আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তারা। চলে যান আত্মগোপনে। পর্যবেক্ষণ করছেন চলমান পরিস্থিতি। মাঠে নামার পরিস্থিতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার নয়, বিএনপি ও জামায়াতের ভয়েই প্রকাশ্যে তারা রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারছেন না। কর্মসূচি গ্রহণ তো দূরের কথা, বাসা-বাড়ি থেকে বের হওয়ার নিরাপদ পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। তবে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলটি এখন নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে। অথচ গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরপূর্তি পালনেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে।

বর্তমানে নেতৃত্ব শূন্য থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। তাদের অনেকেই এখন উদ্বগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ একমাস হয়ে গেল অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।’

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করেছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। ফরিদেপুরের একজন আওয়ামী লীগের কর্মী বলেন, ‘ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।’

তবে বিদেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তর সালে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই দেশ যতদিন থাকবে, আমাদের দলও থাকবে। আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াব।’

হামলার ভয়ে নিজেরা গা ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের পরিবার-পরিজন তাদের এলাকাতে রয়েছেন। তবে আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা বিপাকে পড়েছেন।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকাসহ অন্য জেলাগুলোর নেতাকর্মীরা যখন ‘আত্মগোপনে’ যাচ্ছিলেন, তখন ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির নিজ জেলা গোপালগঞ্জে। শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে গত ৫ আগস্টের পরপরই বেশ কয়েক দফায় বিক্ষোভ মিছিলও করেছিলেন তারা। কিন্তু গত ১৫ অগাস্টের পর গোপালগঞ্জেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আর আগের মতো সক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। মূলত সেনা সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকেই তাদের ওপর ‘চাপ’ ছিল, যা এখন আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।

আত্মগোপনে আওয়ামী লীগ নেতারা। আর কর্মীরা নীরব। নেই দৃশ্যমান কর্মসূচি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে সরব তারা। অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত এবং ছাত্র সমন্বয়কদের সমালোচনাসহ নিজেদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তাদের অনেকের লেখায় আত্মসমালোচনাও বেরিয়ে আসছে। জনসমাগমের পুরনো ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছেন। সব মিলিয়ে তারা বেছে নিয়েছেন ডিজিটাল রাজনীতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে ‘ প্রবাস জীবন’ নামে একটি আইডি খোলা হয়েছে। সরকার পতনের পর থেকে এই আইডিতে প্রতিদিন আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক বিষয় পোস্ট করা হয়ে থাকে। গতকাল এই আইডিতে লেখা হয়েছে ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষ করতে হলে বাংলাদেশের ইতিহাস মুঝে ফেলতে হবে।’ একটি ছোট অনুষ্ঠানের ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়েছে ‘আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ, এমনভাবে সারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম খোকন লিছেন, ‘আমাদের মধ্যেও সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমে যে ভুলগুলো করেছি, সেটা নিজে থেকে বুঝতে হবে এবং ভুলগুলোর সংশোধন করতে হবে। এরপর তাদেরকে আবার সুযোগ দিতে হবে। তখন, তিনি বা তারা হবেন একজন শুদ্ধ নেতৃত্ব, কারণ ভুল থেকে শিখেছেন।’

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আইডিতে ওসমান গনি সোহেল লিখেছেন, ‘পরিস্থিতি যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে, জীবনে কারও ক্ষতি করবেন না। কেননা আজ হয়তো আপনি শক্তিশালী, কিন্তু একটা সময় শক্তি নাও থাকতে পারে।’ মো. আকাশ লিখেছেন, ‘আমি শেখ হাসিনার সৈনিক। আমরা আবার মাঠে আসবো ইনশাআল্লাহ।’

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের আইডিতে লেখা হয়েছে, ‘আমাকে হুমকি দিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই সাধু। মৃত্যু তো একদিন হবেই। বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হয়ে মরতে চাই। তোদের মত কুলাঙ্গার হয়ে না।’

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পোস্টগুলোতে বীভৎস ছবি ও ভিডিওসমূহ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং বৈষম্য ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ভুল-ত্রুটি ফলাও করে তুলে ধরার চেষ্টা বেশ লক্ষ্যনীয়।

ময়মনসিংহ সদরের সাবেক সংসদ সদস্য, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত-উর রহমান শান্ত তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকে হারাতে হলে, তোমাকে কয়েক হাজার বছর জন্ম নিতে হবে।’

রাজনৈতিক মাঠে দাঁড়াতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুল ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা উগ্র আচরণ করছেন। এলাকায় সৃষ্টি করেছেন আতঙ্ক। বাইরে বের হওয়ার পরিবেশ নেই। দেখা পেলেই অপমান করার চেষ্টা করেন বিএনপির সমর্থকরা। আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার জন্য কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছি বলে জানান প্রিয়তোশ বিশ্বাস বাবুল।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. ফয়সাল হেসেন বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা দেশেই রয়েছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগের কাঠামো বেশ মজবুত। পরিস্থিতির শিকার হয়ে দলীয় তৃণমূল কোন্দলও কেটে যাবে। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করবেন দলীয় নেতাকর্মীরা। ফলে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিএনপি জামায়াতের ভুল-ত্রুটি ও অপকর্ম তুলে ধরার কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান মো. ফয়সাল হোসেন।

ভোরের আকাশ/ সু