অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন করে জুলাইয়ে উদ্বোধনের কথা ছিল। তবে প্রকল্প পরিচালকসহ (পিডি) সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সম্ভব হয়নি। গত মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ভাঙ্গা-যশোর অংশের সিগন্যালিং ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ভাঙ্গা আইকনিক রেলস্টেশন ও টিটিপাড়া আন্ডারপাস নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি। সে সময় রেল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছিল, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে অসমাপ্ত কাজ শেষ করে ডিসেম্বরে এর উদ্বোধন হবে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির শতভাগ কাজ কবে সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে খোদ রেল কর্মকর্তারাই অন্ধকারে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞসহ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
তবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে জুলাই মাসজুড়ে সারাদেশ ছিল উত্তাল। এরই ধারাবাহিকতায় সেই আন্দোলন আগস্টে রূপ নেয় ছাত্র-গণআন্দোলনে এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ছাত্র আন্দোলন শুরু থেকে সরকার পতন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ যেমন গতিহীন ছিল, তেমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক রদবদল ও চাকরিচ্যুতির কারণে রেলের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া পিডি বহাল থাকবেন, নাকি নতুন পিডি নিয়োগের পর প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ শুরু হবে- তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। রেল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছে না। এ অবস্থায় পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ কবে শুরু ও শেষ হবে এবং কবে নাগাদ উদ্বোধন হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রসঙ্গত, ঢাকা-যশোর রুটের দূরত্ব এতোদিন ছিল ৩৬৭ কিলোমিটার। সে সময় এ রুটে একমুখী ট্রেন চলাচলে বা গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগতো ১০ ঘন্টা। তবে পদ্মা রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার (শতভাগ এখনো হয়নি) কারণে সেই দূরত্ব ১৯৫ কিলোমিটার কমে মাত্র ১৭২ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটি উদ্বোধন বা ট্রেন চলাচল শুরু হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র তিন ঘন্টা।
রেলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির কাজের শেষ পর্যায়ে পিডিসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তার উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে নির্ধারিত সময়ে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়নি। এ অবস্থায় গত ৪ মে রেলওয়ের এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম বলেছিলেন, ‘আগামী দুই মাসের মধ্যে ভাঙ্গা থেকে খুলনা, যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত আরেকটি ট্রেন চালু হবে’। আর তার আগের রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গত বছরের শেষদিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘২০২৪ সালের জুনে পদ্মা রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে’। কিন্তু দুই মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী যথাসময়ে প্রকল্পের শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়নি। মেয়াদ বাড়িয়ে আট বছর ধরে চলা এ প্রকল্পের সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমা ছিল চলতি বছরের ৩০ জুন। তবে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) শর্ত অনুযায়ী, এখন এ প্রকল্পের ডিফেক্ট লায়াবিলিটির জন্যে নির্ধারিত এক বছর মেয়াদ চলমান আছে। ডিফেক্ট লায়াবিলিটির মেয়াদে মূলত রেলপথ উদ্বোধনের পরে ত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও সংশোধনের কাজ চলে। তবে উদ্বোধন হতে দেরি হওয়ায় ট্রেন চলাচলও শুরু হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, ডিফেক্ট লায়াবিলিটির জন্যে যথেষ্ট সময় পাওয়া না যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে রেলপথে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব অর্থায়নে ঠিক করতে হবে। এতে এ প্রকল্পে আর্থিক ঝুঁকির আশঙ্কা সৃষ্টি দেখা দিয়েছে। প্রকল্প প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন মাস পর্যন্ত ঢাকা-যশোর ১৬৯ কিলোমিটার পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে উদ্বোধন হওয়া মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ, ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৯৫.৫ শতাংশ। তবে ভাঙ্গা-যশোর অংশের অগ্রগতি ৯৫.৫১ শতাংশ হলেও এ অংশের মূল কাজ সিগন্যালিং ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। প্রকল্প প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নতুন রেলস্টেশন ভবন নির্মাণ কাজে ১৭টি স্টেশনের মধ্যে চারটি ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার কাজ ছয়টি স্টেশনে বাকি রয়েছে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্প জুলাইয়ের মধ্যে চালুর চাপ থাকলেও সিগন্যালিং ব্যবস্থা সম্পন্ন না করে চালু করলে অনেক ঝুঁঁকির আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও রয়েছে। এরমধ্যে ভাঙ্গা আইকনিক স্টেশন নির্মাণ কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে না। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা টিটিপাড়া আন্ডারপাশের নির্মাণকাজ শেষ হতেও ডিসেম্বর লেগে যাবে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন গত মাসে বলেছিলেন, ভাঙ্গা আইকনিক ও টিটি পাড়া আন্ডারপাস ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ড্রেনেজ সিস্টেমের কাজসহ আরও কিছু কাজ বাকি থাকতে পারে। আর সিগন্যালিং সিস্টেম শেষ হতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ লাগতে পারে। এরপর আমরা নভেম্বরে প্রকল্প উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ পাঠাবো। সে সময় উদ্বোধনের তারিখের বিষয়ে নভেম্বরের কথা বলা হবে। সেটা ডিসেম্বরেও হতে পারে।
দেরিতে উদ্বোধন পরবর্তী রেলপথে সমস্যা দেখা দিলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে পিডি বলেন, সিগন্যালিংয়ের ক্ষেত্রে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি ৩ বছর আর সিভিল ওয়ার্কের ক্ষেত্রে এক বছর। আগামী জুনের পরেও যদি সমস্যা হয় সেক্ষেত্রে সিগন্যালিংয়ের কাজে যেহেতু আমাদের কাছে দ্বায়বদ্ধতা থাকবে, সেক্ষেত্রে রেলপথের সিভিল ওয়ার্কও করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। ফলে উদ্বোধনে যে দেরিটা হচ্ছে বা হবে, সেটা ঠিক হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ছাড় পাবেন না, যোগ করেন আফজাল হোসেন।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হচ্ছে। গত বছরের ১০ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এ রেলপথ উদ্বোধন করেন। এর ২০ দিন পর ১ নভেম্বর থেকে নতুন এ রেলপথে শুরু যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল। এরমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা-মাওয়া ৪০ কি.মি. ও মাওয়া-ভাঙ্গা ৪২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-কলকাতা রুটের আন্তর্জাতিক ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেসও রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচল করবে। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে এবং যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
ভোরের আকাশ/মি