logo
আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:২৪
মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন
সিরাজুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা
নিয়ে বিতর্ক ও কিছু প্রশ্ন

অত্যন্ত আলোচিত-সমালোচিত নাম আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে। এই আযমীর সাথে আমার শত্রুতা বা বন্ধুতা নেই। তিনি গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’-এ ৮ বছর বন্দি ছিলেন এবং শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তিনি সেখান থেকে মুক্তি পান বলে তিনি দাবি করেন। সেখানে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। কোন প্রমাণ ছাড়াই তার এই দাবিকে সত্য ধরে নিয়েছি আমি। এ কারণে তার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। তবে তার কয়েকটি দাবি আমাকে, আমাদেরকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন এবং সংবিধান পুনরায় লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই দাবিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এর পেছনে দূরভিসন্ধি আছে বলে মনে হয়। হয়তো অনেকে বলবেন- এটা একান্ত তার ব্যক্তিগত অভিমত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। হ্যাঁ, আছে। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা বলা নয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিষয়ে বিতর্ক কারো কাছে কাম্য নয়। আযমীর মতো একজন মানুষের কাছে গঠনমূলক; দেশ-জাতির কল্যাণ হয়- এমন মতামত মানুষ প্রত্যাশা করে।

২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের তথ্যকে ‘কাল্পনিক’ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছিলেন আযমী। এবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহীদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করেন, একচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার উপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করেন।’

এখানে আযমীর কাছে আমি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। প্রথমত, শেখ মুজিব তিন লাখ বলতে গিয়ে তিন মিলিয়ন বলেছেন। আপনি এই তথ্য কোথায় পেলেন? শেখ মুজিবের সাথে আপনার কখনো কথা হয়েছে? নাকি শেখ মুজিব অন্য কাউকে বলেছেন? এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনো ডকুমেন্ট আছে? থাকলে সেটা প্রকাশ করুন। জাতি সত্যটা জানুক।

আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন। আপনি বলছেন ২ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আবার বলছেন তিন লাখকে তারা (আওয়ামী লীগ) ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছেন। তার মানে আপনি ৩ লাখ নিহত হয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন। ২ লাখ ৮৬ হাজার নাকি ৩ লাখ মানুষ মারা গেছেন; সেটা ক্লিয়ার করুন।

আপনার বাবা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিলেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং সে সময় ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল ৪২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। তার মধ্যে গোলাম আযমও ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। এ কারণে আপনার দেওয়া নিহতের সংখ্যা নিয়ে মানুষ ষড়যন্ত্র ভাবতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। আপনার অবস্থান ক্লিয়ার করাও আপনার দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে আপনি সরকারের কাছে জরিপ করার দাবি জানিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এই জরিপ করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আশাকরি সরকার একটা পদক্ষেপ নেবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে মানুষের মন থেকে ভ্রান্তি দূর করবে সরকার। মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম লুটে নিয়েছেন; সেটা কিন্তু আপনি বলেননি। আপনি ভুল করেছেন; নাকি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন- সেটা খুব জানতে ইচ্ছা করে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ বলছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই? আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’

আযমীর এই দাবি অনেকের মতো সঠিক মনে হবে। হ্যাঁ। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা যেতেই পারে। দেশের প্রয়োজনে; মানুষের চাহিদার কারণে সেটা হতে পারে। কিন্তু দেশে এমন কী ঘটলো যে জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে? একটা সংগীত দেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি হয় কীভাবে? দেশ যখন ক্রান্তিকাল পার করছে; একটার পর একটা সমস্যা সামনে আসছে; সেগুলোর দিকে নজর না দিয়ে আপনি পড়ে আছেন জাতীয় সংগীত নিয়ে। বিষয়টা নিয়ে খুবই অবাক হচ্ছি।

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়েছেন আযমী। তিনি বলেন, ‘১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেড নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি- আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।’

তারা (আওয়ামী লীগ) জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি বলে আযমী যে প্রশ্ন তুলেছেন; সেটাকে আমি অবান্তর প্রশ্ন বলতে চাই। কারণ আওয়ামী লীগ তো যুদ্ধ করার জন্যও ম্যান্ডেড নেয়নি। তার মানে কী যুদ্ধটা অবৈধ? এই যুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম; সেটাও কী অবৈধ? যদি স্বাধীনতা অবৈধ না হয়; তাহলে সংবিধান প্রণয়নও অবৈধ নয়। আর স্বাধীনতা বৈধ হলে সংবিধানও বৈধ। কারণ স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রয়ণনের জন্য ম্যান্ডেড নিতে হয় না। বিশে^র কোনো দেশ স্বাধীনতা লাভের পর সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেড নিয়েছে- এমন নজির নেই। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান বৈধ।

আবার আসি জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কালজয়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষেত্রে গানটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১৯ বছরের পুরনো গানটি আজও মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে; উজ্জীবিত করে। এর আবেদন একটুও কমেনি। বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় ঘটাতে এ গানের ভূমিকা অনেক। এ গানের একটা ইতিহাস আছে। সুতরাং এটা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে আযমী একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। ভাগ্যিস তিনি জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়ার দাবি তোলেননি। আফগানিস্তানে এর আগে তালেবান শাসনের সময় জাতীয় সংগীত বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে আবার সেটা চালু করা হয়েছে।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল। ওই বছরের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে একটি প্রতিবাদ সভায় এই গান প্রথম গাওয়া হয়। সেই বছর ৭ সেপ্টেম্বর (২২ ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দ) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এই গান প্রচার করেন। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে এই গান ব্যবহৃত হয়। জহির রায়হান নির্মিত এই সিনেমায় তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গাওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানের প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।

আযমীর প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শেষ করব। তিনি বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের দাবি তোলেননি- এ কারণে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; সে কারণে তার প্রতি ভালোবাসা। নতুন বাংলাদেশ-এ যেন কেউ আর নির্যাতনের শিকার না হয়- এই প্রত্যাশা করছি সরকারের কাছে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।
ফোন: ০১৯২০৭৬৬৬৫৮।

 

ভোরের আকাশ/মি