logo
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৫:০৮
জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে কৌশলী বিএনপি
এম. সাইফুল ইসলাম

জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে কৌশলী বিএনপি

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আগামী জাতীয় নির্বাচন তথা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য বক্তব্যের মাধ্যমে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। তবে এ বিষয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সময় বেঁধে দেয়া প্রশ্নে তাদের এই বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল নাকি মতপার্থক্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে মতপার্থক্যের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে দলটির নেতৃবৃন্দ বলছেন, শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যের মূলবার্তা একই। সরকার পতনের পর থেকেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দেয়ার কথা বলছেন। দলটির অনেক শীর্ষ নেতাও মহাসচিবের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। তবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ সংস্কারে বর্তমান সরকারকে যৌক্তিক সময় দেয়ার পক্ষে বলেছেন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা এই সরকারকে অবশ্যই সংস্কারে সময় দেবে। তবে সেটি যৌক্তিক সময় হতে হবে। প্রকৃত গণতন্ত্র পেতে হলে নির্বাচিত সরকারের কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন তারা। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কোন বিষয়ে রাজনৈতিক দলের কৌশল থাকাটা খারাপ কিছু নয়। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। হাসিনা সরকারের পতনকে নিজেদের দীর্ঘ আন্দোলনের একটি পরিণতি বা সমাপ্তির অধ্যায় বলে মনে করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘদিন তাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের শেষটা নামিয়েছে ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও বিএনপির গণতান্ত্রিক লড়াই শেষ হয়নি বলে মনে করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুততম সময়ে মৌলিক সংস্কারের পর একটি নির্বাচনে দেবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে সেটিই হবে গণতান্ত্রিক সরকার। যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সুফল পাবেন দেশের মানুষ।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুইদিন পর গত ৭ আগস্ট রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। ওইদিনের সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংঘাত বা প্রতিহিংসা এড়িয়ে শান্তির বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। আর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দেন। এরপর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ওই সরকার গঠনের পরও প্রায়শই বিএনপি মহাসচিব দ্রুত সংসদ নির্বাচন দাবি করছেন। ২৪ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ভাসানী অনুসারী পরিষদ আয়োজিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বিএনপি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন। প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশের সুফল বয়ে আনতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জোর দেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব ওই অনুষ্ঠানে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, তারা একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। নির্বাচনের পাশাপাশি দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। ৯ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ফের মির্জা ফখরুল দ্রুত সময়ে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার আহবান জানান।

এরপর ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। যে ভাষণে রাষ্ট্রের ৬ প্রতিষ্ঠান সংস্কারে কমিশন গঠন ও তার প্রধানদের নাম ঘোষণা করেন। এর পরের দিন ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সমন্বয় সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সংস্কার কমিশন গঠন করলেও নির্বাচনী রোডম্যাপ না থাকায় জাতি কিছুটা হতাশ হয়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বরও বিএনপি মহাসচিব দ্রুত নির্বাচন দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান। ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে সমাবেশ করে বিএনপি। ওই সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। অন্যথায় বিজয় হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করে বক্তব্য দেন তিনি। অথচ একইদিন প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, কোনোভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং লাখো কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল। এই সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সকলের কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে কিন্ত এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। তারেক রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ কিংবা যেকোনো দেশেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি। এ জন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া দরকার।

গতকাল শনিবার দুপুরেও গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন দেরি হলে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হবে। তাতে করে আওয়ামী লীগের লোকজন অপকর্ম করে বিএনপির উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করবে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যকে কিভাবে দেখছেন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা, তা জানতে দৈনিক ভোরের আকাশ এর পক্ষ থেকে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ বিষয়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি যৌক্তিক সংস্কারের কথা বলছেন দলের সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমান। তার এ কথা যুক্তিসংগত। সংস্কারের জন্যে কিছুটা সময় লাগবে এটিই সত্য। তবে, কেউ যেন সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ না করে সে ব্যাপারে দলের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সে জায়গা থেকে হয়তো মহাসচিব দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, মূল কথা হচ্ছে বিএনপি একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ চায়। কবে নাগাদ একটি নির্বাচন হবে তার প্রাথমিক একটি ধারণা পাওয়ার দরকার আছে। এ বিষয়ে দলের নেতাদের বক্তব্য সাংঘর্ষিক নয় বলেও মনে করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্ধারিত কোন দিন বা মাসের কথা বলছি না। তবে একটি রোডম্যাপ আমরা অবশ্যই চাই। আমরাও বুঝতে পারছি যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় কিছু সময় লাগবে। একারণে আমরা ধরাবাঁধা কোনো সময়ের কথা বলছি না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। যাতে আমরা বুঝতে পারবো কবে নাগাদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফিরে আসবো। সেই জিনিসটা আমরা চাই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি রাষ্ট্রের একটি সংস্কার চায়। পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনও চায়। কারণ, প্রকৃত অর্থে একটি সংস্কার করতে হলে অবশ্যই নির্বাচিত সংসদের কোন বিকল্প নেই। যে সংসদ একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হবে। নির্বাচিত সংসদ না হলে অনেক কিছুই সংস্কার করা সম্ভব নয়। দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যের মূলবার্তা একই। তবে, দল হিসেবে বিএনপির কৌশল থাকতেই পারে।

বিএনপির নির্বাচন দাবির বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে প্রত্যেক দলের একটি নিজস্ব নীতি বা কৌশল থাকে। সেটি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে দলটি বেশ এগিয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচনে সময় দেয়া প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে কিছুটা কৌশল থাকতেই পারে। কেউ কেউ সরকারকে কিছুটা চাপে রাখতে এমন বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন। তবে দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে মূলবার্তা একই বলেও মনে করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, সংস্কার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রকৃত সংস্কার করতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠারও প্রয়োজন রয়েছে।

ভোরের আকাশ/ সু