logo
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৯:১৬
রপ্তানির নামে অর্থ পাচার!
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

রপ্তানির নামে
অর্থ পাচার!

শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে দেশে আসার কথা। অথচ, এমন ৯৯টি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান বিদেশে পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে আনেনি সমুদয় অর্থ। টাকার পরিমাণও কম নয়। প্রায় সাত কোটি ৭৯ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় প্রায় ৯২০ কোটি ১২ লাখ টাকা। ৯৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক থেকে ২৭২ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে এমন ৩২টি প্রতিষ্ঠানের অর্থও দেশে আসেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৮৬০ কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেছে। এরমধ্যে দেশের বৃহত্তম বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৯টি। তাদের মাধ্যমে ৬৬১ কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, রপ্তানির ১২০ দিনের মধ্যে পিআরসি আসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের টাকা আসেনি। এমনকি দুই থেকে আড়াই বছর পার হলেও টাকা আসেনি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের। টাকা ফেরত না আনার তালিকায় রয়েছে মোহাম্মদী গ্রুপ, কেডিএস, এসকিউ, কেয়া, ডিবিএল, নাসা ও নিপা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও। প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার করেছে, নাকি কৌশলে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়েছে- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে এমন জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের আয়কর ফাঁকি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর শুল্ককর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসে। কিন্তু রপ্তানি-পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে পিআরসি আসার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু লিয়েন ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানিমূল্য না আসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন মনিটরিং সিস্টেমে তা ওভার ডিউ হিসেবে প্রদর্শিত হয়। বন্ড কমিশনারেট এমন ২০৩টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করে দেখেছে। যার মধ্যে ১০৪টি প্রতিষ্ঠানের অর্থ (ডলার) দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে। বাকি ৯৯টি প্রতিষ্ঠানের সাত কোটি ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৪ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯২০ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭১২ টাকা (এক ডলার সমান ১১৮ টাকা ধরে) দেশে আসেনি। এনবিআর ঘোষিত ২০২১ সালের এক আদেশ অনুযায়ী, কোনো বন্ডেড প্রতিষ্ঠান এক কোটি বা তার বেশি শুল্ককর ফাঁকি দিলে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শেয়ারহোল্ডারদের আয়কর ফাঁকি রয়েছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি রয়েছে কি না- তা সিআইসি ও শুল্ক গোয়েন্দা দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আয়কর ফাঁকি ও প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের ৯টি প্রতিষ্ঠান পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৯ দশমিক ১৪ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৬৬১ কোটি ৫২ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ টাকা (প্রতি ডলার সমান ১১৮ টাকা ধরে)। ৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২৫ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৬ দশমিক ২১ ডলার (২৯ কোটি ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৯৫২ টাকা), ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৭৭৭ দশমিক ৬৫ ডলার (২০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬২ টাকা), বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড এক কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার ২৩৬ ডলার (২২৪ কোটি ৫৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৪৮ টাকা), অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেড দুই কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪ ডলার (২৭১ কোটি ৮১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫২ টাকা), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট লিমিটেড কোম্পানি লিমিটেড ৭৫ হাজার ৫৬৪ ডলার (প্রায় ৮৯ লাখ টাকা), অ্যাসেস ফ্যাশনস লিমিটেড ৩৮ লাখ ২২ হাজার ১৮৭ ডলার (৪৫ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৬৬ টাকা), পারলেস গার্মেন্টস লিমিটেড ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ ডলার (২৩ কোটি ৫৮ লাখ ২৩ হাজার), ইলহাম ফ্যাশন লিমিটেড আট লাখ ১৬ হাজার ৬৪৩ ডলার (নয় কোটি ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৩৪ টাকা)। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ২০২২ ও ২০২৩ সালে পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোনো টাকা দেশে আনেনি। নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ড্রেসেস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ লাখ সাত হাজার ৮৪৭ দশমিক ২১ ডলারের (১১ কোটি ৮৯ লাখ ২৫ হাজার ৯৭০ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। তারাও দেশে কোনো টাকা আনেনি। দেশে টাকা প্রত্যাবাসিত না হওয়ার কারণ জানতে চেয়ে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদারের মোবাইলে ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

চট্টগ্রামভিত্তিক কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেডিএস অ্যাক্সেসরিজ লিমিটেড (ইউনিট-২)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত এক লাখ ২৬ হাজার ২০ দশমিক ৩৬ ডলারের (প্রায় এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। মোহাম্মদী গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করলেও টাকা দেশে আসেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এম জি শার্টেক্স লিমিটেড, এম জি নাইস স্ট্রিচ লিমিটেড, মোহাম্মদী গ্রুপ লিমিটেড। এর মধ্যে এম জি শার্টেক্স লিমিটেড চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পণ্য রপ্তানির ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৯৪ দশমিক ২৩ ডলার (প্রায় ১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা), এম জি নাইস স্ট্রিচ লিমিটেড ২০ লাখ চার হাজার ২৬৪ দশমিক ৪০ ডলার (২৩ কোটি ৬৫ লাখ তিন হাজার ১৯৯ টাকা), মোহাম্মদী গ্রুপ লিমিটেড দুই লাখ চার হাজার ১৯০ দশমিক শূন্য নয় ডলার (প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা) দেশে আনেনি। প্রতিষ্ঠান তিনটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। একইভাবে এস কিউ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস কিউ বিরিচিনা লিমিটেড। ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৫৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩৩ দশমিক ১২ ডলারের (প্রায় ৬৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও সমুদয় অর্থ দেশে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। কেয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৩১ দশমিক ৮৯ ডলারের (প্রায় ১৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু দেশে টাকা আসেনি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক পাঠান বলেন, রপ্তানির ডলার দেশে এসেছে। তবে, তিনটি ব্যাংকের কারণে আমার ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে ডলার জমা হয়নি। এরমধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংকে ২৬৬ মিলিয়ন ডলার, ন্যাশনাল ব্যাংকে ১২০ মিলিয়ন ডলার ও পূবালী ব্যাংকে ১৩ কোটি ডলার জমা হওয়ার কথা। ব্যাংক তিনটির কারণে আমার কারখানা ও রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কালার সিটি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ৯৬ হাজার ২৯৮ দশমিক ৭০ ডলারের (প্রায় এক কোটি ১৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। আজিম অ্যান্ড সন (প্রা.) লিমিটেডের এক লাখ ১৪ হাজার ৬৫২ দশমিক ৪৭ ডলার (প্রায় এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা), উইনওয়্যার লিমিটেডের পাঁচ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪২ দশমিক ৬২ ডলার (প্রায় ছয় কোটি ৯৩ লাখ টাকা), ফ্রেন্ডস স্টাইল ওয়্যার লিমিটেডের চার লাখ ৫৬ হাজার ৪২০ দশমিক ২৫ ডলার (প্রায় পাঁচ কোটি ৩৮ লাখ টাকা), সোয়ান নিট কম্পোজিট লিমিটেডের ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬৪ ডলার (প্রায় ৩৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা), কটস বাংলাদেশ লিমিটেডের সাত লাখ আট হাজার ৬৩৭ ডলার (প্রায় আট কোটি ৩৬ লাখ টাকা), ক্লাসিফিয়া ফ্যাশন লিমিটেডের তিন লাখ ৬১ হাজার ৭২২ ডলার (প্রায় চার কোটি ২৬ লাখ টাকা), প্যানাসি নিটেড ক্রিয়েশনস লিমিটেডের এক লাখ ১৮ হাজার ৩৪৬ ডলার (প্রায় এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা), সুপ্তি সোয়েটার লিমিটেডের এক লাখ ২৮ হাজার ২৬০ ডলার (প্রায় এক কোটি ৫১ লাখ টাকা), আরবান ফ্যাশন লিমিটেডের এক লাখ ২০ হাজার ৫১৩ ডলার (প্রায় এক কোটি ৪২ লাখ টাকা) দেশে আসেনি। অন্যদিকে, নিপা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কে সি জ্যাকেট ওয়্যার কোম্পানির দুই লাখ ৭৭ হাজার ২৯৫ দশমিক ৯৩ ডলারের (প্রায় তিন কোটি ২৭ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। মন্ডল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আলিম নিট (বিডি) লিমিটেডের দুই লাখ ১৭ হাজার ৯৩৬ দশমিক ২০ ডলারের (প্রায় দুই কোটি ৫৭ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও টাকা দেশে আসেনি। স্টফাটেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের ছয় লাখ ছয় হাজার ১৮৭ দশমিক ৩৯ ডলারের (প্রায় সাত কোটি ১৫ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। আমেরিকান অ্যান্ড ফ্রাইড (বাংলাদেশ) লিমিটেডের এক লাখ ১২ হাজার ৭৬২ দশমিক ১৪ ডলারের (প্রায় এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। সীমা ফ্যাশন এক লাখ ১৬ হাজার ৯ দশমিক ৬৮ ডলারের (প্রায় এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। ডিএসএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওয়েমার্ট অ্যাপারেলস লিমিটেড এক লাখ তিন হাজার ৪৯৮ দশমিক ৯৯ ডলারের (প্রায় এক কোটি ২২ লাখ টাকা) পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে টাকা আসেনি। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ জুন পর্যন্ত পণ্য রপ্তানি করেছে। টাকা কেন দেশে আসেনি- এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি