logo
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৯:৩৪
বেদখল হচ্ছে ভাওয়াল বনাঞ্চল
বনরক্ষার চেয়ে আত্মরক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন কর্মীরা
শফিকুল ইসলাম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি

বেদখল হচ্ছে ভাওয়াল বনাঞ্চল

গাজীপুরের ভাওয়াল শালবন দখলের মচ্ছব চলছে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রশাসনের নীরবতার কারণে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে দখলবাজরা। বিএনপির কতিপয় নেতার নাম ভাঙিয়ে দখলের উস্কানি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু জনপ্রতিনিধি, দালাল এবং সুবিধাবাদীদের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি চক্র বনাঞ্চল দখলে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। বন দখল প্রতিরোধ করতে গিয়ে লাগাতার হামলার শিকার হচ্ছে বনকর্মীরা। গত দেড় মাসে ৩০ বনকর্মী দখলদারদের হামলায় আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন। ফলে তারা বনরক্ষার চেয়ে আত্মরক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

জানা গেছে, ৫ আগস্ট থেকে সোমবার পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বনের গাছ কেটে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাটসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত বনের গেজেট বাতিলের দাবিতে আয়োজিত জনসভায় অতিথি হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন জয়দেবপুর থানার ওসি আব্দুল হালিম। এতে চরম বিপাকে পড়েছে গাজীপুর সদর উপজেলায় কর্মরত বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল মনসুর মন্ডলের নাম ব্যবহার করে একটি চক্র উপজেলার পটকা মৌজায় বনের ২৪৩ নম্বর সিএস দাগে গাছপালা কেটে ক্লাবঘর নির্মাণ কাজ শুরু করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর। খবর পেয়ে বাধা দিতে গেলে বনকর্মীদের ধাওয়া করে বনদস্যুরা। প্রাণ বাঁচাতে বনকর্মীরা শ্রীপুর রেঞ্জ অফিসে ফিরে আসেন। এ বিষয়ে বিএনপি নেতা আবুল মনসুর মন্ডল বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি এমন কাজে জড়িত নন। তার নাম কেউ ব্যবহার করে কেউ যদি ক্লাব ঘর নির্মাণ করে থাকেন; তাহলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। আমাদের দল এসব কাজ করে না। গত ১২ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর উপজেলার তেলীহাটি মৌজায় বনের ৭৯৯ নম্বর সিএস দাগে দখল প্রতিরোধ করতে যান বনকর্মীরা। সেসময় বিএনপির নাম ব্যবহার করে কয়েকজন বনকর্মীকে হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী গত ১৪ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-৭২১) করেন। একইভাবে শ্রীপুর রেঞ্জের কাওরাইদ বন বিটের যুগিরসিট, সিপির মোড়, নয়াপাড়া, এলাকায় বিএনপির নাম ব্যবহার করে একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন এলাকায় বনের জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া সাতখামাইর, রাথুরা বিটে বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে একটি সিন্ডিকেট ভূমিদস্যুদের বনে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করে আসছে।

বন বিভাগ জানায়, গাজীপুর সদর উপজেলায় বনভূমি দখল উৎসবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবিদ হোসেন বাবুল। তিনি বিগত দিনে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় ছিলেন। বর্তমানে ভূমিহীনদের সমর্থন পেতে ভূমিদস্যুদের সাথে হাত মিলিয়ে বন দখলে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছেন। তার অন্যতম সহযোগী ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য সাহিদা আক্তার। আবিদ হোসেন বাবুলের নেতৃত্বে গাজীপুর সদর উপজেলার মাইজপাড়া, ভবানীপুর, মোহাম্মদীয়া, নয়াপাড়া, গুচ্ছগ্রাম এলাকায় বনকর্মীদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভূমিদস্যুরা। এ বিষয় আবিদ হোসেন বাবুল বলেন, বন বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষকে হয়রানী করে আসছে। সে জন্যই স্থানীয় মানুষরা বিক্ষোভ করছে।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট থেকে অদ্যবদি ভূমিদস্যুদের নিয়ে কয়েকটি জনসভার আয়োজন করেন আবিদ হোসেন বাবুল। এসব সভায় জবরদখল প্রতিরোধে গেলে বনকর্মীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়। গত প্রায় দেড় মাসে ভবানীপুর বিটের বনকর্মীদের উপর ৫টি হামলা হয়েছে। এ সময় বনে ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মিত হয়েছে প্রায় এক হাজার। ভবানীপুর বিটে বন দখলের সূত্র ধরে পার্শ্ববর্তী মনিপুর বিটের বনকর্মীদের উপর ৩টি হামলা হয়েছে। ওই বিটের বনাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক। হামলার ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে জয়দেবপুর থানায় তিনটি লিখিত অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি বনভূমি জবরদখলকারীদের তালিকা দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, বিগত ৫ আগস্ট গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ৮টি চায়না রাইফেল, ৪টি শর্টগানসহ ৭৫৫ রাউন্ড গুলি লুট করে। আগ্নেয়াস্ত্র লুট হওয়ার প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী। এতে চরম আতঙ্কে রয়েছে বনকর্মীরা। গত প্রায় দেড় মাসে কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল করিম, চন্দ্রা বিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নানসহ ১৫ জন বনকর্মীর উপর ৫ বার হামলা হয়েছে। এসব হামলার ঘটনায় কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা ও একটি জিডি দায়ের করেছে বন বিভাগ। একই উপজেলার কাচিঘাটা রেঞ্জে বন দখল প্রতিরোধ করতে গেলে গত ৫ সেপ্টেম্বর যাথিলা বিট কর্মকর্তা মাসুম মিয়া ও তার সঙ্গীয় বনকর্মীদের উপর হামলা চালায় ভূমিদস্যুরা। এ ঘটনায় মাসুম মিয়া মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বনকর্মীদের উপর হামলার ঘটনায় গত প্রায় দেড় মাসে কাচিঘাটা রেঞ্জের বিভিন্ন বিট থেকে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা, একটি লিখিত অভিযোগ এবং ৫টি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হয়েছে।

শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোকলেছুর রহমান জানান, জবরদখল প্রতিরোধ তো দূরের কথা; টহল কার্যক্রমেই বনকর্মীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে। থানায় মামলা দিতে গেলে মামলা নেয় না পুলিশ। মাসের পর মাস বন বিভাগ কর্তৃক দায়ের করা লিখিত অভিযোগের সুরাহা হয় না। বেশ কিছু এলাকায় বনকর্মীরা যাতে প্রবেশ করতে না পারে; সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ভূমিদস্যুরা। এভাবে চলতে থাকলে যেকোন সময় বনকর্মীদের উপর বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল করিম বলেন, প্রাণ হারানোর আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি বিটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাভাবিক টহল কার্যক্রমে হামলার ঘটনা ঘটছে। চোখের সামনে বন দখল হয়ে যাচ্ছে। অথচ বন বিভাগ জেলা প্রশাসন থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছে না।

ভাওয়াল রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হক বলেন, মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি মিলে একটি সিন্ডিকেট ভাওয়াল রেঞ্জের ভবানীপুর বিটের বনাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শুধু বন আইন প্রয়োগ করে এই ভূমিদস্যুতা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ার কথা অস্বীকার করে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন বলেন, বন বিভাগের সাথে আমাদের নিয়মিত সভা হচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করতেও প্রশাসন সচেষ্ট। তবে এখন আমরা ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে দায়িত্বপালন করছি; সে দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/মি