logo
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:৫০
প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
কিংবদন্তির মহানায়ক মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী
কাজল সরকার

কিংবদন্তির মহানায়ক মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী

কিংবদন্তির মহানায়ক মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগীর মহাপ্রয়াণ দিবস আজ । ১৯৮৮সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন উপমহাদেশে মুসলিম জাতিসত্ত্বার প্রবক্তা। উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সমাজহিতৈষী, চির সংগ্রামী-বিপ্লবী, আধ্যাত্মিক রাহবার ও মুজাদ্দিদ। তিনি একাধারে আলেমেদ্বীন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তীক্ষ্ণমেধাবী লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় অলিয়ে কামেল। বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের সব্যসাচী কারিগর। ঘনঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতির দূর্দিনের মুক্তির কাণ্ডারী, আলোর দিশারী ও তাঁর কালের আলোকিত মানুষ।

মাওলানা শামছুল হুদা পাচঁবাগী রহ. ইংরেজী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ও বাংলা ১৩০৩ সালের ফাল্গুন মাসে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। । তার পিতার নাম মৌলভী ক্বারী রিয়াজ উদ্দিন। তিনি কিংবদন্তি আলেম রশিদ আহম্মদ গাঙ্গুহীর খলিফা ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর মাতা উম্মে কুলসুমও ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার নারী।

শিশুকালে তিনি মাতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। কোনো স্কুল বা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি এতই মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন যে কোনো বিষয়ই একবারের অধিক পড়ার প্রয়োজন হতো না।মাদরাসায় ভর্তির পর হতেই শামছুল হুদার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। তিনি খুব আগ্রহের সাথে প্রতিটি শ্রেণিতে সিলেবাস বর্হিভূত নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে ছিলেন। তিনি জামাত-ই-উলার চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৮% নম্বর প্রাপ্ত হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে তিনি শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ ক্রমে দীনি ইলমের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের রামপুর স্টেট মাদরাসায় ভর্তি হন । তিনি ইংরেজি শিক্ষার জন্য লাহোরের অরিয়েন্টাল কলেজে চলে যান। অরিয়েন্টাল কলেজ থেকে মাওলানা শামসুল হকের তেমন কিছু শেখার ছিল না। তিনি তখনি ভালো মানের ইংরেজি জানতেন।

১৯৩৬ সালে যখন গফরগাঁও উপজেলার ঐতিহ্যবাহী উস্থি ইডনিয়ন ভেঙ্গে পাঁচবাগ ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়, তখন আন্দোলন- সংগ্রামের অগ্রমহানায়ক কিংবদন্তি মাওলানা শামছুল হুদার সম্মানে ইউনিয়নের নাম হয় পাঁচবাগ ইউনিয়ন এবং শামছুল হুদা পাঁচবাগী রহ. হন নতুন সৃষ্ট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এমএলএ ও এমএনএ (আইনপ্রণেতা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি ইমারত পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন দলটির সভাপতি ও সানাউল্লাহ ছিলেন দলটির সহসভাপতি। ১৯৪৬ সালেও তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।মাওলানা শামসুল হুদা আজীবন অবহেলিত নিপীড়িত নিষ্পেষিত নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্বে দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী থেকে শুরু করে নানা ধরনের মামলা হয়েছে। এ জন্য তাঁকে ভীষণ দুঃখ-কষ্ট, জেল-জুলুম, হুলিয়া সহ্য করতে হয়েছে।

এরপর হতেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সহ দেশের মেহনতি কৃষকদের মুক্তির জন্য সারা জীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। আন্দোলন করার কারণে ব্রিটিশ সরকার, জমিদার সংগঠন এবং পাকিস্তান সরকার সব মিলিয়ে ১০২১টি মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি সকল মামলা সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেন। বাঙালি মুসলিম মহাজগরণের পুরোধা জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগনের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

মহান শিক্ষাসংস্কারক মাওলানা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে সময় মাদরাসায় শুধুমাত্র আরবি ছাড়া অণ্য কোন বিষয় সিলেবাসে অর্ন্তভুক্ত ছিলনা তখনকার সময়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত সহ সিলেবাস বর্হিভূত পড়াশোনা করাতেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে। তিনি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্থানী হায়েনাদের হাত থেকে হিন্দু, মুসলমান পুরুষ ও মা বোনদের রক্ষা করতে তার বাড়ীতে মসজিদে ও মাদরাসায় আশ্রয় দান করেন।

ধীমান জ্ঞান তাপস, প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক বহুভাষাবিদ, আলেমেদ্বীন মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী উপমহাদেশের একজন পথিকৃৎ সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি বাংলা, আরবী ও উর্দু ভাষায় যথাক্রমে ‘দ্বীন-দুনিয়া, হুজ্জাতুল ইসলাম ও তর্জুমানে দ্বীন’ নামে তিনটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। ‘দ্বীন-দুনিয়া’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৬ সালের আষাঢ় মাসে, তাঁর গ্রামের বাড়ি গফরগাঁও থানার পাঁচবাগ থেকে।

মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী রহ. আজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান আল্লাহর অলি, প্রিয়বান্দা, দীন ইসলামের সাধক সাবেক জাতীয় গণপরিষদ সদস্য ১৯৮৮ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ৯১ বছর বয়সে ময়মনসিংহে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর পর পাঁচবাগ জামে মসজিদের উত্তর পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

 

ভোরের আকাশ/মি