logo
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:০০
বাইডেন-ইউনূস ঐতিহাসিক বৈঠক আজ
দৃষ্টি সবার নিউইয়র্কে
নিখিল মানখিন

দৃষ্টি সবার নিউইয়র্কে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার দুপুরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই বৈঠক নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব স্বাগত জানায়। এই প্রেক্ষিতে বাইডেন-ইউনূস বৈঠক খুবই গুরুত্ব বহন করে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপড়েন চলছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করে আসছিল। ফলে এই বৈঠক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রেক্ষাপট হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

তাদের মতে, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের আস্থা ও ভরসার জায়গা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা দেশ। গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোরালো সমর্থন জানানোর পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। ১০৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং হাজার হাজার কোটি ডলার লুটপাটে জর্জরিত বাংলাদেশের অর্থনীতি। নিয়ন্ত্রণে নেই দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সর্বত্রই বিরাজ করছে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চলছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। ড. ইউনূস সরকারও অব্যাহত রেখেছে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের জন্য বিশ্বস্ত ও আস্থার বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই। চেনা বন্ধুপ্রতিম দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নতুন পরিচয়ে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস। দীর্ঘদিনের পরিচিত নেতৃত্বের সামনে তুলে ধরবেন তার নতুন দায়িত্ব, নতুন বাংলাদেশকে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার টেবিলে থাকবে নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে সংস্কার ইস্যু। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে, সেটি নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন তিনি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন তিনি। একই সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জায়গা, বিভিন্ন সংস্কারের কৌশলগত বা টেকনিক্যাল দিকে সাপোর্ট, বিদেশে টাকা পাচার, অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে চলমান তদন্ত- এসব বিষয়েও ড. ইউনূস ও বাইডেনের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘরে-বাইরের চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে ড. ইউনূসের যোগদান বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বৈঠক করার সুযোগটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ঘিরে সর্বত্রই আলোচনা চলছে। কারণ গত তিন দশকে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বৈঠক কখনো হয়নি। বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কারণে ২৪ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে একদিন আগে গতকাল সোমবার নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হন।

কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে তার নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে জাতিসংঘের অধিবেশনে আগত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক কিংবা সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তাই ড. ইউনূস ও বাইডেনের বৈঠক নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের শক্তি ও ভরসা আদায় করার সুযোগ।

কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেছেন, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছেন। দুই সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন বৈঠক করতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের সামনের দিনের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র যে সব ধরনের সহায়তা করবে, নিউইয়র্কের আসন্ন বৈঠক সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের ভেতরে ও বাইরে বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়া যে যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থাগুলো যে জোরালোভাবে যুক্ত থাকবে; ড. ইউনূস ও বাইডেনের বৈঠক সেই বার্তাই দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, সাধারণত দ্বিপক্ষীয় বা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলো ওয়াশিংটনে হওয়ার কথা। নিউইয়র্ক-তো মাল্টিলেটারাল (বহুপাক্ষিক), কাজেই এখানে সচরাচর এ ধরনের বৈঠক হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক নিউইয়র্কে হলে এটা আমাদের জন্য ‘উল্লেখযোগ্য’ একটা ঘটনা হবে।

আমরা এখন আঞ্চলিকভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে আছি। আমরা অভ্যন্তরীণভাবেও বেশ জটিল অবস্থার মধ্যে আছি। সেদিক থেকে এই বৈঠক খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকলে যেটা হয়, মার্কিন শীর্ষ পর্যায়কে বাংলাদেশের এখনকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা যায় এবং এখনকার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় যেটুকু সমর্থন দরকার সে কথাটা তুলে আনা যায়। এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মার্কিনিদের একটা ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান বলে মনে করেন তিনি।

পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই বৈঠকের বার্তা হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় দুই দেশ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর জন্য এটি একটি সুযোগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট এবং সরকার-গৃহীত বিভিন্ন খাতে সংস্কার পদক্ষেপগুলো নিয়েও আলোচনা করতে পারবেন প্রধান উপদেষ্টা।’

মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে ঢাকা সফর করেছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মার্কিন দলের বৈঠক হয়েছে। ভবিষ্যৎ সহযোগিতা আরও বেগবান করার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্ভাব্য এই বৈঠকটি ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার কারণে আবারও রোহিঙ্গা সমস্যা জটিল হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ নিয়েও কথা হতে পারে বলে জানান তিনি।

ভোরের আকাশ/ সু