logo
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:০৮
বানভাসীদের দুর্ভোগের নেপথ্যে
আশীষ কুমার দে

বানভাসীদের দুর্ভোগের নেপথ্যে

  • নদী-খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাধার দূষণ, দখল ও ভরাট
  • ৫ বছরের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
  • দখলদারদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থাগ্রহণ করার তাগিদ


ভাটির দেশ, প্লাবনভূমি ও হিমালয়সহ একাধিক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান হওয়ায় বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিবছর বন্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বন্যা শেষেও প্লাবিত জনপদ দীর্ঘদিন জলমগ্ন থাকাটা অস্বাভাবিকই বটে। বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীসহ এবারের বন্যাকবলিত জনপদগুলো এর নির্মম সাক্ষী। গত মাসে স্মরণকালের বন্যার পরও বিস্তীর্ণ ওই অঞ্চলের অনেক জনপদ এখনো জলমগ্ন।

নদী, খাল, বিল ও হাওর-বাওড়সহ শত শত উন্মুক্ত জলাধার দূষণ, দখল ও ভরাটের কারণেই এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অপরিণামদর্শী এক শ্রেণির মানুষের এ ধরনের পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ডের ফলে উন্মুক্ত জলাধারগুলোর আন্তঃসংযোগ বা প্রাকৃতিক প্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে এবার বন্যার এতোদিন পরও অনেক জনপদে আটকে রয়েছে পানি।

তবে সমস্যা যে শুধু এবারের বন্যাকবলিত এলাকার, তা নয়; সারাদেশেই একইভাবে নদী, খাল, বিল ও হাওর-বাওড়সহ উন্মুক্ত জলাধারগুলো দূষণ, দখল ও ভরাটের শিকার। এবার কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যার পরও দীর্ঘদিন পানি আটকে থাকায় সমস্যাটা সামনে এসেছে। এরপর জানা গেল, ওইসব অঞ্চলের সব ধরনের জলাধারের বেশিরভাগেরই একই দশা। যে কারণে মাস পেরিয়ে গেলেও পুরোপুরি পানি এখনো নামেনি।

কুমিল্লা: কুমিল্লার গোমতী নদীর বাঁধ বিভিন্ন পয়েন্টে ভেঙে জেলার ১৭টি উপজেলার ১৪টিই বন্যাকবলিত সৃষ্টি হয়। কিন্তু এবার বন্যার পানি আগের বছরগুলোর মতো দ্রুত নামছে না। প্লাবিত উপজেলাগুলোর মধ্যে মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোটের পানি ধীরগতিতে নামছে। এসব জনপদের ৫ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি। প্রাপ্ততথ্য মতে, এই তিন উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদী ও এর শাখা খালগুলো দখল করে রেখেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি। ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত এ নদীর গড় প্রস্থ ২২০ ফুট হলেও বর্তমানে ওই অঞ্চলের অনেক স্থানে প্রস্থ ৩০ ফুটে নেমে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীরাই নন; সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও খাল ভরাট করে মাছচাষ ও কৃষির বারোটা বাজিয়েছে। ‘খাল ভরাট করে সর্বনাশা’ কাজ করেছে কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ২০২০ সালের শুরু থেকেই ‘কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ভরাট করা হয়েছে শত বছরের প্রাচীন জলাধার ‘বেরুলা খাল’। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬০ কিলোমিটার। খালটির উৎসমুখ ডাকাতিয়া নদীর কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশের ফতেপুর গ্রামে। এ খাল লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ হয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী খালে গিয়ে মিশেছে। এরপর সেখান থেকে এই পানি যেত বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু ভরাটের কারণে ওই অঞ্চল থেকে পানি নামতে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার একর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত ও শত শত কৃষকের সর্বনাশ হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্যার পানি সরতে পারছে না।

নোয়াখালী: বন্যায় নোয়াখালীতে অন্তত ১৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছিল। অর্ধলক্ষ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এক মাস পরও পানি আটকে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে কিংবা বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। এমন দুর্ভোগের জন্য নদী-খাল দখলকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় যে খালগুলো দিয়ে বৃষ্টি অথবা বন্যার পানি মেঘনা নদীতে যায়, সেসব খালের বিভিন্ন জায়গা দিনের পর দিন দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা। খালের ওপর এবং এর দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। ফলে বন্যার পানি সরতে সময় লাগছে।

জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ভবানী জীবনপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং শিশুসংগঠক ও সংস্কৃতকর্মী আবুল ফারাহ পলাশ বলেন, ঘর-বাড়িতে গত ১৮ আগস্ট বন্যার পানি উঠেছে; যা এখনো নামেনি। এখনো হাঁটুপানি তার বসতঘরে। তিনি বলেন, জীবনপুর গ্রামের পাশে বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর সড়কের সঙ্গে একটি খাল আছে। স্থানীয়ভাবে এটি ‘গাবুয়া খাল’ নামে পরিচিতি।

খালটি বসিরহাট, ছয়ানী রাজগঞ্জ ও মাইজদী হয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে পড়েছে। ১০ বছর আগে ভবানী জীবনপুর থেকে সামনের দিকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। স্লুইসগেটটি নির্মাণের শুরু থেকেই এ খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ কারণে বন্যার পানি নামছে না। একসময়ে নোয়াখালীর খরস্রোতা ‘মহেন্দ্র খাল’ দখল-দূষণে এখন বিপন্ন। অথচ ব্যবসায়ীরা ছোট-বড় ট্রলার ও নৌকায় এ খাল দিয়ে মেঘনা-ডাকাতিয়া নদী হয়ে পণ্যসামগ্রী বিভিন্ন হাট-বাজারে পরিবহন করতেন।

নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য নোয়াখালীতে একসময়ে শত শত দীঘি খনন করা হয়েছিল। পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল; ছিল নোয়াখাল, বেগমগঞ্জের ওয়াপদা খাল, ভুলুয়া খালসহ ছোট-বড় অসংখ্য খাল। এই খালগুলোর মধ্যে যে আন্তঃসংযোগ ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন জায়গায় দখল নিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভাটির পানি খাল বেয়ে নেমে যাওয়ার আর পথ নেই। তিনি বলেন, আজকের মাইজদী শহর গড়ে উঠে খালের ওপর। ওই খালটির নাম ছিল ছাগলমারা খাল। এর পাশেই ছিল নোয়াখাল। দখলদারদের কবলে পড়ে এসব খাল এখন অস্তিত্ব সংকটে।

বিশেষজ্ঞ মতামত

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা এবং হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, অপরিণামদর্শী এক শ্রেণির মানুষের পরিবেশবিনাশী কর্মকান্ডের ফলে উন্মুক্ত জলাধারগুলোর আন্তঃসংযোগ বা প্রাকৃতিক প্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে। নদী, খাল, বিল ও হাওর-বাওড়সহ শত শত উন্মুক্ত জলাধার দূষণ, দখল ও ভরাট করেছে তারা। যে কারণে এবার বন্যার এতোদিন পরও অনেক জনপদে পানি আটকে থাকায় এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ম. ইনামুল বলেন, সংকট উত্তরে অন্তত ৫ বছর মেয়াদি একটা মহাপরিকল্পনা দরকার। সে অনুযায়ী নদী-খালের পুরনো চ্যানেলগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। সেগুলোর ওপর নির্মিত সব ধরনের স্থাপনা ভাঙতে হবে। জলাধারগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ তৈরি করতে হবে। অভিজ্ঞ এই প্রকৌশলী আরো বলেন, দখলদারদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছ থেকে নদী দখলদারদের তালিকা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এখনই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে প্রকৌশলী ম. ইনামুল বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় রাজনৈতিক সরকার আসলে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

ভোরের আকাশ/ সু