বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন এবং যেকোনো সময়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গতকাল সোমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই আশ্বাস দেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে (নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে) জাতিসংঘের সদর দপ্তরের নির্ধারিত সভাকক্ষে বৈঠকটি হয়।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ বৈঠক হওয়ার তথ্য দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সকল ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা জো বাইডেনের কাছে তুলে ধরেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে।
এসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেকোনো সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
বাইডেন বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহলে তাদেরও (যুক্তরাষ্ট্র সরকার) পূর্ণ সহযোগিতা করা উচিত।
প্রেস উইং জানায়, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লব চলাকালীন এবং এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি-সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক বাইডেনকে উপহার দেন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের একজন কূটনীতিক বলেন, এর আগে কোনো বৈঠক হয়নি। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হয়েছে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে ড. ইউনূস গত সোমবার নিউইয়র্কে পৌঁছান। জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে তিনি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজ সিং রূপন, জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কসহ অন্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে গত সোমবার ভোর ৫টায় ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীরা। দোহায় উড়োজাহাজ বদলে তারা নিউ ইয়র্কের জেএফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান সোমবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ১০ মিনিটে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ৮ অগাস্ট বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই ইউনূসের প্রথম বিদেশ সফর। ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের নেতা হিসেবে তিনি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন।
কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানান জাতিসংঘের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মদ আবদুল মুহিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ডিএম সালাউদ্দিন মাহমুদ।
বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিক শেষে প্রধান উপদেষ্টা যান গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে। নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালে এই হোটেলে তিনি ও তার সফর সঙ্গীরা অবস্থান করছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত শনিবার বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণ অভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশসমূহ হতে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে উঠে আসতে পারে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, সফরকালে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাই কমিশনার, বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইডের প্রশাসকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক হতে পারে।
এবছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদরদপ্তরে একটি উচ্চ-পর্যায়ের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধান, জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
তিন দিনের সফর শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার পথে রওনা হবেন প্রধান উপদেষ্টা। এবার তার সফরসঙ্গীর সংখ্যা নিরাপত্তা, প্রেসসহ সব মিলিয়ে ৫৭ জন।
বিএনপির উল্লাস, আ.লীগের বিক্ষোভ : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার আগমনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনন্দ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং একই সঙ্গে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ।
কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি আট নম্বর টার্মিনালে অবতরণের আগেই বাইরে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা টার্মিনাল এলাকা। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকেই জেএফকে বিমাবন্দরে জড়ো হয় প্রধান উপদেষ্টাকে বরণ করতে আসা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানা ধরনের শ্লোগান দিতে থাকেন। টার্মিনালের আরেক পাশে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রতিবাদসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মদ আবদুল মুহিত এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ডিএম সালাউদ্দিন মাহমুদ বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টাকে অভ্যর্থনা জানানোর পর মোটর শোভাযাত্রা সহকারে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ম্যানহাটনের অভিজাত হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভোরের আকাশ/ সু