logo
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:০০
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন
ধূম্রজাল কাটার আভাস
নিখিল মানখিন

ধূম্রজাল কাটার আভাস

জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তার ইঙ্গিত দিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমর্থনের অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য বারবার তাগিদ আসছে। অপরাপর রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ আসছে। কিন্তু দেশে কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়ীত্ব এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। এমনকি নির্বাচন প্রশ্নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে রাজপথে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে থাকা জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট ধূম্রজাল কেটে যাওয়ার আভাস মিলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চতা চলছিল। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করে আসছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণেও তা ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা দ্বিতীয় ভাষণে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। ৬ বিশিষ্ট নাগরিককে এ কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশনের প্রধানরা ড. ইউনূসের সঙ্গে একটি বৈঠকও করেছেন। কাজ শেষে তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে জানা গেছে। এরপরও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছিল না। এমন প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতিফলন বাস্তবে ঘটলে সেটি হবে দেশে গণতন্ত্রের জন্য বড় মাইলফলক।

সেনাপ্রধান আঠার মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন সে বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, বিএনপি মনে করেন নির্বাচন যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। নির্বাচন যত দ্রুত হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ জানান, ‘সেনাপ্রধান সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তার বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচন বিষয়ে আমাদের আমির দলের অবস্থান আগেই তুলে ধরেছেন। তিনি জরুরি সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের কথা বলেছেন। আপাতত এটুকুই এ বিষয়ে দলের বক্তব্য।’

ধুম্রজাল যে কারণে

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার ১৬ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট প্রথমবার নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনার ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওইদিন তিনি বলেন, আমরা দেখতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা যা করতে চান, তার পরিকল্পনা জনগণের সামনে উপস্থাপন করছেন। তিনি কীভাবে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছেন, কীভাবে তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবেন, তার একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করা উচিত বলে জানান মির্জা ফখরুল। পরবর্তীতে একে একে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এবিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে গত ৩১ আগস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ও নির্বাচনের রূপরেখা তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথমদফা আলোচনা শেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের নানা প্রস্তাব তুলে ধরেছে। নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনায় যেসব সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সরকার নির্বাচনের একটি রূপরেখা তৈরি করবে। এটি চূড়ান্ত করার আগে আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে তারা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তাদের সিদ্ধান্ত নয়।

তিনি বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এর জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।

এতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল হলে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবারও নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণার দাবি জানায় বিএনপি।

গত ১২ ও ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি আরেকটু জোরালোভাবে তুলে ধরেন। সর্বশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর তিনি একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, নির্বাচন দেরি হলে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। তাতে আওয়ামী লীগের লোকজন অপকর্ম করে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করবে। পালিয়ে যাওয়া সরকারের দোসররা দেশে অস্থিরতা করে বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলতে চাইছে।

এদিকে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না বলে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এড়িয়ে গেলেও গত ২৩ আগস্ট তা অনেকটা স্পষ্ট করেছেন। এদিন বিকেল সোয়া চারটার দিকে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পুরনো স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, একটি দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী করতে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের উন্নয়ন জনগণের নির্বাচিত সরকার দ্বারাই সম্ভব। কারণ, জনগণের সরকার হলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। যেহেতু জনগণের সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ভোটের মাধ্যমে। তাই যেদিন বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিনই মানুষ তার পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরে পাবে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল যা বলল

রোডম্যাপ অবিলম্বে সংস্কারের রূপরেখাসহ রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রতি দাবি জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। নেতারা বলেছেন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ সবখানেই সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলে এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে না। তাই নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখনই আলোচনা করা দরকার। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিক্ষোভ সমাবেশে নেতারা এসব কথা বলেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তারা বলছে, আমরাও মনে করি এসব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব প্রতিষ্ঠানগুলো কতদিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে তা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরন ও প্রক্রিয়া কী হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতি দ্রুত প্রকাশ করবে এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। গত ২০ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টন দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দলের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম।

গত পহেলা সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ও আর্থিক অনুদানের চেক প্রদান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমরা এই মুহূর্তে কোনো তারিখ হিসাব করছি না। সরকারের এখনও এক মাস হয়নি। আরেকটা মাস পার করুক। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা অর্থবহ হবে না। তবে দীর্ঘ সময় নয়, নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে।’

ভোরের আকাশ/ সু