logo
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৩:৪৬
দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কাকে কি দিশা দেখাতে পারবেন?
চিররঞ্জন সরকার

দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কাকে কি
দিশা দেখাতে পারবেন?

বয়স ৫৫ বছর। তবু শশ্রুমণ্ডিত লোকটিকে দেখে মনে হয় টগবগে এক যুবক। ঠিক মারদাঙ্গা হিন্দি তামিল সিনেমার নায়কের মতো। ব্যক্তিটি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে যে সাফল্য দেখালেন, সেটা তো হার না-মানা অপ্রতিরোধ্য যুবকেরই কীর্তি। পরিবারতন্ত্রের দুর্ভেদ্য দুর্গের রাজনীতির দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিশ্বকে একরকম চমকে দিলেন। তার নাম অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তার জোটের নাম ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। দলের নাম জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেবিপি)। এই জোটটি এর আগে বিরোধী দলও ছিল না। দেশটির ২২৫ সদস্যের সংসদে তাদের আসন ছিল মাত্র তিনটি। অথচ এই জোট থেকেই দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রয়েছে ক্রিকেটে খ্যাতি। পর্যটকদের কাছেও দেশটি আকর্ষণীয়। আর্থিক সংকটে জর্জরিত এবং ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া এই দেশটি গত কয়েক বছর ধরে লড়াই করছে অর্থনীতির খুঁটিটাকে সোজা রাখার জন্য। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার ১০তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ হয়। প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট পড়ে। দিশানায়েকের ন্যাশনাল পিপল’স পাওয়ার জোট ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পাওয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল সামাগি জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ আর্থিক সংকটে জেরবার হওয়ার পরে এটাই শ্রীলঙ্কার প্রথম নির্বাচন। ওই বছরই তীব্র জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে চরমে ওঠে ক্ষোভ। গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাড়িছাড়া হন দুজনেই। এর পর ক্ষমতায় এসে দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে নানা পদক্ষেপ নেন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা বিক্রমাসিংহে। এবারও প্রেসিডেন্টের দৌড়ে শামিল তিনি। কিন্তু শেষ হাসি তিনি হাসতে পারেননি, হেসেছেন তার বামপন্থী প্রতিপক্ষ দিশানায়েকেই।

দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দিশানায়েকের উত্থানের গল্প যেন রূপকথার মতো। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া দিশানায়েক ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনের কঠোর সমালোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের চেয়ে নিজেকে ভিন্ন হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি।

রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা একেবারে কম নয়। ছাত্র বয়স থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২০০০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি কৃষি, প্রাণিসম্পদ, ভূমি ও সেচ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী হুইপ হিসেবে কাজ করেন। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৭তম জাতীয় কনভেনশনে তিনি জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা তাকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।

২০১৯ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। সে বছর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু দমে যাননি। পরাজয় থেকে উদ্দীপনা খুঁজেছেন। এই ফলাফলের পরেই তৃণমূল পর্যায়ে দল গড়া ও প্রচারের কাজ শুরু করেছেন। দুই বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ‘ব্যবস্থা পরিবর্তনের’ দাবিকে সামনে এনেছেন। সেই লক্ষ্যে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি জনগণের অসন্তুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট ভোটকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন।

দিশানায়েকের দল মার্কসবাদী জনতা বিমুক্তি পেরেমুনা বরাবর জোরদার রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ এবং জনকল্যাণকর সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেছে। বড়লোকদের ওপর করারোপ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরোধিতাকে সমর্থন করেছে। তার দুর্নীতিবিরোধী কঠোর পদক্ষেপ এবং গরিবের প্রতি নীতির প্রতিশ্রুতি প্রভাবিত করেছে ভোটারদের। তিনি নিজেকে পরিবর্তনের প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরেছেন।

যদিও ‘ব্যবস্থা পরিবর্তন’ সহজ কাজ নয়। রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। আগামী সাধারণ নির্বাচনে দলকে ভালো ফল করতে হবে। ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে সংস্কারের আশা ভেস্তে যেতে পারে। তদুপরি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করার সময় জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাও চ্যালেঞ্জিং। তাকে গ্রামীণ ভোটারদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে জরুরি ত্রাণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে; যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিশানায়েকে যদিও বলেছেন, আমরা শ্রীলঙ্কার ইতিহাস পুনর্লিখনের জন্য প্রস্তুত। নির্বাচিত হওয়ার পর ‘এক্স’-এ একটি বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘শতবর্ষ ধরে আমরা যে স্বপ্ন লালন করেছি তা অবশেষে সত্যি হচ্ছে।

এই অর্জন কোনো একক ব্যক্তির কর্মের ফল নয়, শত-সহস্র মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। আপনার প্রতিশ্রুতি আমাদের এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে এবং এর জন্য আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। এই বিজয় আমাদের সকলের।’

লক্ষ্য অটুট থাকলে যে পথের দিশা খুঁজে পাওয়া যায়, তার প্রমাণ দিশানায়েকে। তিনি সবার অগোচরে দল গুছিয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক বৃহত্তর জোট গড়ে তুলতে পেরেছেন। প্রত্যয় আর দৃঢ়তা দিয়ে সকল প্রতিকূলতা জয় করেছেন। জনতার কাছে নিজের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। পথে নেমেছেন। পথে থেকেছেন। পথে নামলে অনেক কিছুই সম্ভব। পথই পথ দেখায়। নিয়ে যায় গন্তব্যে। চলার পথে ভুল হয়, হতে পারে, সেই ত্রুটি শুধরে নিয়ে পথ চলা অব্যাহত রাখতে হয়। দিশানায়েক তা করে দেখিয়েছেন। দিশানায়েকের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে, জেভিপি দলটি দুইবার শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করে। তখন প্রায় হাজার মানুষ রক্তাক্ত সংঘাতের বলি হন। কিন্তু বিদ্রোহগুলোর ব্যর্থতার পর দিশানায়েকে এবং তার দল শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভেতরে থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করেন। তিনি শ্রীলঙ্কার পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান নেন, বিশেষত রাজাপাকসে পরিবারের দীর্ঘকালীন আধিপত্যের বিপরীতে।

বিশ্বজুড়ে বামপন্থা যখন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে, তখন দিশানায়েকে বামপন্থাতেই বাজিমাৎ করেছেন। তিনি বামপন্থায় বিশ্বাস রেখেছেন। সমতার স্বপ্ন দেখেছেন। দেখিয়েছেন। দিশানায়েক তার সৎ এবং সোজাসাপ্টা রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার জন্য নয়, বরং সমাজের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য লড়াই করার সংকল্প তাকে আলাদা করে তুলে। দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান, আর্থিক ন্যায়বিচার এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের আহ্বান তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে। দিশানায়েক নিজেকে একজন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি কোনো ধনী বা ক্ষমতাশালী পরিবারেরও সদস্য নন; যা তাকে অনেক ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তিনি আগামী দিনে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন কি-না, সবাই এখন সেই প্রশ্ন করছেন। এ জন্য অবশ্য অপেক্ষার বিকল্প নেই।

দীর্ঘদিন ধরেই শ্রীলঙ্কা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আসলে গরিব দেশগুলোর সংকট কখনো শেষ হয় না। একটি সংকটের উত্তরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংকট এসে হাজির হবে, হাজির হয়। আমরা আমাদের জীবনের পথ চলা দিয়েই তা বুঝতে পারি। ব্যক্তির জীবনে যেমন, সমাজ ও রাষ্ট্রেও সংকট আসবে, আসে। সেই সংকট জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো যোগ্য নেতার হাত দিয়ে মোকাবিলা করবে কিনা সেটাই মূল কথা। সেই জায়গাটা ধরার জন্য তিনি কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতির শ্রীলঙ্কায় তার পথচলা মসৃণ হওয়ার কথা নয়। তাকে সবার আগে খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য যা করার তা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক প্রভাববলয় ও ঋণচক্রে জর্জরিত দেশটির জন্য খুব সহজে সব কিছু সামলানো কঠিন। দেশটিতে রয়েছে ভারতের প্রবল প্রভাব। চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বিনিয়োগ। আইএমফের শর্তসাপেক্ষ ঋণ। পশ্চিমারাও যে তাকে খুব স্বস্তিতে রাখবে, সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। এ পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ঋণের বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে তাকে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। সব রকম বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি হয়তো তা পারবেনও। কিন্তু দিশানায়েকের মতো নেতা আমরা কবে পাব? আদৌ পাব কি?

লেখক: কলামিস্ট।

 

ভোরের আকাশ/মি