logo
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:৩০
সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও বিত্তশালীদের বাসাবাড়িতে কোটি কোটি খবরে হানা
কোটি টাকার আশা, মিলছে শুধুই হতাশা
গোলাম মুজতবা ধ্রুব

কোটি টাকার আশা, মিলছে শুধুই হতাশা

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলামের (ছদ্ম নাম) মোবাইল ফোনে হঠাৎ করেই আগস্টের শেষ সপ্তাহে পরিচিত বন্ধু মো. মিজানুর রহমানের (ছদ্ম নাম) মোবাইল নম্বর থেকে কল আসে। ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে প্রয়োজনীয় কুশলাদি জানার মিজানুর তাকে গম্ভীর গলায় জানতে চান, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কারও সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে কি-না? উত্তর ইতিবাচক হওয়ার পরপরই গলার স্বর অনেকটা নীচু করেই মিজানুরের প্রশ্ন ছিল, সিরাজ তাকে একটা কাজ করে দিতে করতে পারবেন কী না? ওই কাজটি করতে পারলে তাদের বাকি জীবনে অর্থবিত্ত নিয়ে আর কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা থাকবে না। সারাটা জীবন আরাম-আরেশ করে নিশ্চিন্তেই পার করে দিতে পারবেন। এরপর ফোনে আর কথা না বাড়িয়ে জরুরি কথা বলতে সরাসরি দেখা করতে চান মিজানুর। সরাসরি দেখা হওয়ার পর মিজানুর জানান. একটি বাড়িতে বিপুল অর্থ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সেটি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে দিয়ে অভিযান চালিয়ে জব্দ করে দিতে পারলেই তারা দুইজনই একটি বড় অংকের কমিশন পাবেন। এতে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বাড়িতে বিপুল অর্থ পাওয়ার কোনো ধরনের সুযোগ ছিল না। হতাশ হয়ে যান সিরাজুল ও মিজানুর।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে চলে যান। সরকার পতনের পর মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে পলাতক, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, আবার কেউ পালিয়ে দেশ ছেড়েছেন। সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের বিত্তশালীদের নেতাদের কারও কারও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার কারও কারও ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয়। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সাবেক-বর্তমান আমলা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া খবর প্রকাশ পায়। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও আমলাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল দেশি-বিদেশি অর্থ উদ্ধারও করে। গত দেড় মাসে সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ অন্তত ৮০ জন প্রভাবশালীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই সুযোগ একটি সংঘবদ্ধ চক্র সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ঘরবাড়ি, ব্যক্তিগত অফিস ও গোপন আস্তানা টার্গেট করে অর্থের সন্ধান করছে। কিন্তু কারি কারি অর্থ তো দূরের কথা লাখ টাকাও মেলেনি। হতাশ হতে হয়েছে তাদের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি সূত্র বলছে, কোনো কোনো বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সাবেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিপুল সম্পদের খোঁজ দেবেন দাবি করে কেউ কেউ কারো কারো সহায়তা প্রার্থনা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই অর্থ উদ্ধার করতে পারলে সোর্স মানি হিসেবে তাদেরও অর্থ দিতে হবেÑ এমন শর্ত জুড়ে দিয়ে তারাও এখন বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক বনে যাবেন বলে আশায় রয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, যারা তথ্য দিতে চাইছেন তাদের কাছে থাকা তথ্যগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এজন্য প্রথমদিকে কিছুটা উৎসাহ দেখালেও এখন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারাও এসব অর্থ উদ্ধার করে দেওয়ার চটকদার তথ্যে ভুলছেন না। তারা বলছেন, তথ্য যাচাই-বাছাই না করে তারা কোনো ধরনের অভিযানে যান না এবং যাবেনও না।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মো. আশরাফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তথ্য পান মগবাজারের একটি বাড়িতে বিপুল অবৈধ সম্পদ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে অভিযান পরিচালনা করানো গেলে তার ভাগ্যও খুলে যাবে। তাই তিনি তার পরিচিত যারা আছেন তাদের সঙ্গে সর্ব্বোচ্চ যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। পরে এক রাতে দীর্ঘ আট ঘণ্টা অপেক্ষা করে তার এক বন্ধুর সন্ধান পান, যিনি তাকে আশ^স্ত করেন সত্যিই কোনো অবৈধ অর্থ কোথাও থাকলে সেখানে অভিযান চালানোর ব্যবস্থা তিনি করতে পারবেন। পরে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা চাওয়ার পর জানতে পারেন, একাধিক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে ওই বাড়ির তথ্য দিয়েছেন এবং যাচাই-বাছাই শেষে তারা নিশ্চিত হয়েছেন তাদের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। শুধু মগবাজার নয়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুর, গুলশান, বনানীসহ কয়েকটি এলাকার বাসা ও ফ্ল্যাটে এই ধরনের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে গত এক মাসে বিভিন্ন জনের কাছে তথ্য থাকার খবর রয়েছে বলে আলোচনা আছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন এমন একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে যাচাই-বাছাই শেষে তার কোনো ধরনের সত্যতা মেলেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে পুলিশ কোনো তথ্য পেলেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করার কথা আপাতত ভাবছে না। অভিযান পরিচালনা করতে হলে এখন তাদের নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে কেউ কোনো ধরনের জটিলতায় জড়াতে চাচ্ছেন না। তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কেউই কোথাও বিপুল অবৈধ অর্থ আছে সেই খবর পেয়ে অভিযানে যেতে আগ্রহীও নন। কোনো কারণে অভিযান পরিচালনার করার পর সেখানে কিছু পাওয়া না গেলে উল্টো অভিযানে অংশ যারা নিয়েছেন তাদের বদনামের ভাগিদার হতে হবে। তাই তারা অনেকটাই এইসব তথ্য এড়িয়ে চলতে চাইছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুদকের অনেকের কাছেই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উদ্ধার করে দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ আসে। সংস্থাটি অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে থাকে বলে তারা তাদের কাছে আসা অভিযোগগুলো প্রথমেই যাচাই-বাছাই করে। এখন পর্যন্ত তারা যেসব খবর পেয়েছে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন। খবর পেয়ে খোঁজ নেওয়ার পর সেখানে অর্থের কোনো নামগন্ধও পাওয়া যায় না। তাই একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কাউকে কোনো তথ্য দেওয়া থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকার অনুরোধ জানান তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ভোরের আকাশকে বলেন, পুলিশ যেকোনো কাজেই জনগণের সহযোগিতা চায়। জনগণও পুলিশকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। তথ্য পাওয়ার পর আমরা সেগুলো সব সময় অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে থাকি। তারপরও সবার প্রতি আহ্বান থাকবে যারাই কোনো তথ্য দেবেন সেগুলো যেন সঠিক হয়।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই ধরনের নানা ধরনের তথ্য দেওয়ার কথা বলে তারা বাড়তি মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা করছেন। র‌্যাব বলতে চায় এই ধরনের সুযোগ কারো নেই। দেশের কোথাও যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় এটা র‌্যাবকে তথ্য দিলে, যদি এটা টাকা পয়সা বা কোনো ধরনের অবৈধ সম্পদের কোনো কিছু থাকে সেখানে আমরা ব্যবস্থা নেব। এই তথ্য তারা দুদককেও দিতে পারে। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম আছে। অথবা যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে আমরা সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে পারি এবং সেখান থেকে আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তল্লাশি অভিযানের মাধ্যমে এগুলো আমরা করছি। অনেকেই আমাদের তথ্য দিচ্ছেন। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, দুদক একটি বড় প্রতিষ্ঠান। অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে তারা কাজ করে থাকে। যেকোনো ধরনের তথ্য পেয়ে তারা সেগুলো প্রথমে যাচাই-বাছাই করে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুর্নীতির যেকোনো তথ্য যদি পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলো সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে দুদক অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।


ভোরের আকাশ/ সু