logo
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:২০
অবৈধ বাসের রক্ষক কে
আশীষ কুমার দে

অবৈধ বাসের রক্ষক কে

  • বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার
  • প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি
  • নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না যানজট


রাজধানী ঢাকার ওপর দিয়ে এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে চলাচলকারী বাসগুলোর সিংহভাগেরই নেই বৈধ কাগজপত্র। ফলে এসব বাস মালিকদের কাছ থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। অন্যদিকে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে চলাচলকারী এসব গণপরিবহনে প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যাও কম। এরা অহরহ ট্রাফিক আইনও লঙ্ঘন করে থাকেন। ফলে সড়কে নিত্যদিনই ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি অসহনীয় যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। খোদ ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) বিভিন্ন সূত্র থেকেই পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

তবে এমন পরিস্থিতির জন্য এককভাবে কোনো পক্ষকে দায়ী করতে রাজি নন যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা। পরিবহন মালিক, শ্রমিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সর্বোপরী সরকারকে দায়ী করছেন তারা। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় গণপরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফসল। এজন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি সরকারও সমানভাবে দায়ী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকার কোনো এলাকা দিয়ে কত বাস চলে এবং কতগুলো অবৈধ, এ সম্পর্কিত তথ্য ডিটিসিএর ‘প্রিপারেশন অব কনসেপ্ট ডিজাইন অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান ফর বাস রুট রেশনালাইজেশন অ্যান্ড কোম্পানি বেজড অপারেশন অব বাস সার্ভিস ইন ঢাকা’ শীর্ষক প্রকল্পে উল্লেখ রয়েছে। তাদের সংগৃহীত মাঠপর্যায়ের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকার শাহবাগ মোড় দিয়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২২৫টি বাস চলাচল করে; যার মধ্যে ৬৫৫টিই অবৈধ।

ডিটিসিএর তথ্য বলছে, ঢাকায় মূলত অর্ধশতাধিক পরিবহন কোম্পানি এসব অবৈধ বাস পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে শিকড়, ট্রান্স সিলভা, বিহঙ্গ, এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, তরঙ্গ, মালঞ্চ, শুভযাত্রা, মেঘলা, বোরাক, হিমাচল, সাভার, ওয়েলকাম, দেওয়ান, মেঘনা বোরাক, রজনীগন্ধা, সময় ট্রান্সপোর্ট, মিডলাইন, ডি-ওয়ান, বসুমতি, ট্রাস্ট, ভিক্টর, আলিফ, প্রচেষ্টা, রবরব, অগ্রদূত, রইচ, অছিম, রাইদা, ফাল্গুন, রাজধানী সুপার, আকাশ, ইকবাল, মিরপুর সুপার লিংক, মেট্রো লিংক, স্বদেশ, ট্রাভেলস মার্ট, মৌমিতা, বেস্ট শতাব্দী, বিকল্প, এলাইক, রংধনু, গাজীপুর পরিবহন, হিমালয়, ল্যামস, আল মক্কা, আয়াত, প্রভাতী বনশ্রী, বলাকা, আজমেরী, তাসিন, বিকাশ, মনজিল, মিরপুর ইউনাইটেড, তানজিল, লাব্বায়েক, খাজা বাবা, কোমল, উৎসব, তুরাগ, এমএম লাভলী, গ্রীন অনাবিল, ঠিকানা, পরিস্থান ও কিরণ মালা পরিবহন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শাহবাগের মত একইভাবে মতিঝিল দিয়ে চলাচল করা ৫৭৫টি বাসের মধ্যে ২৬২টি অবৈধ। এছাড়া মহাখালী দিয়ে চলাচল করা ১ হাজার ৯৪টির মধ্যে ৫১৪টি অবৈধ, ফার্মগেট দিয়ে চলাচল করা ৬৪৯টির মধ্যে ৩৪২টি অবৈধ, বাড্ডা-রামপুরা দিয়ে চলাচল করা ১ হাজার ২৮৩টির মধ্যে ৬৩৩টি অবৈধ, আজিমপুর দিয়ে চলাচল করা ৪১২টির মধ্যে ২৬১টি অবৈধ, যাত্রাবাড়ী দিয়ে চলাচল করা ৭৫৪টির মধ্যে অবৈধ ৪৫০টি এবং মিরপুর দিয়ে চলাচল করা ৬৫৭টি বাসের মধ্যে ৪৩৩টিই অবৈধ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘এ-৩০৯’ রুট হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর ব্যস্ততম বাসরুটগুলোর একটি। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান হয়ে পল্টন, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, আসাদগেট, গাবতলী ও সাভার হয়ে নবীনগর পর্যন্ত বিস্তৃত রুটটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এ পথে বর্তমানে দৈনিক ২০৪টি বাস পরিচালনা করছে সাভার পরিবহন লিমিটেড। ডিটিসিএর মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, এ রুটে থাকা সাভার পরিবহনের ২০৪টি বাসের মধ্যে ১৩৭টিই অবৈধ। এর মধ্যে ৮৩টি বাসের কোনো রুট পারমিটই নেই।

ঢাকার আরেকটি ব্যস্ত বাসরুট এ-৪০৬। ঘাটারচর থেকে সোনারগাঁ পর্যন্ত এ রুটে প্রতিদিন ১২২টি বাস পরিচালনা করছে রজনীগন্ধ্যা পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেড, যার মধ্যে কেবল ১৩টি বাস বৈধ। এ-৩১৭ (দিয়াবাড়ি-পোস্তগোলা) রুটে দৈনিক ২১১টি বাস পরিচালনা করছে রাইদা এন্টারপ্রাইজ; যার মধ্যে অবৈধ বাস ১০০টি। এ-৪৪১ (নন্দন পার্ক-চাষাঢ়া) রুটে চলাচল করা মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ১৯৮টি বাসের ১৫১টিই অবৈধ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার, বর্তমানে কারাবন্দি আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামান এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড কোম্পানির অন্যতম মালিক।

রাজধানীতে বাসের রুট নির্ধারণ ও বিভিন্ন কোম্পানির বাসকে রুট পারমিট দেয় ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি’। ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলছেন, কমিটির অনুমোদন না নিয়ে পরিবহন মালিকরা অবৈধভাবে বাসগুলো পরিচালনা করছেন। পরিবহন মালিকরা যদিও বলছেন, কমিটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তারা অনুমোদনহীন বাস পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটে সৃজন পরিবহন নামের একটি কোম্পানির বাস চলাচল শুরু হয়েছে। গ্রীন ঢাকা নামের আরেকটি কোম্পানি একই রুটে বাস পরিচালনা শুরু করেছে। নতুন এ দুই কোম্পানিসহ ঢাকায় চলাচল করা সব অবৈধ বাসের তথ্যসংগ্রহ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ও বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ধ্রুব আলম। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। রুট ধরে ধরে অবৈধ বাসগুলো চিহ্নিত করছি এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছি।’

রুট পারমিটবিহীন ও রুট লঙ্ঘনকারী এসব বাসকে ডিটিসিএ অবৈধ হিসেবে অভিহিত করলেও তার সঙ্গে একমত নন পরিবহন মালিকরা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘ঢাকায় বাসের রুট পারমিট দেয় আরটিসি (রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি)। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ কমিটি রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছে।

পরিবহন মালিক নেতা সাইফুল আলম বলেন, এই তিন বছরে অনেক কোম্পানির বাস পরিবর্তন হয়েছে। আবার নতুন রুটের চাহিদাও তৈরি হচ্ছে। আমরা তো পারমিট নিয়েই বাস চালাতে চাই। আমাদের একদিকে রুট পারমিট দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে এসব বাসকে অবৈধ বলা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। এ বাসগুলো নিয়ম লঙ্ঘন করে চললেও কোনোভাবেই অবৈধ নয়। কারণ এগুলোর রুট পারমিট না থাকলেও নিবন্ধন, ফিটনেস সনদসহ সমস্ত শুল্ককর পরিশোধ করা আছে। তাহলে এগুলো কীভাবে অবৈধ হলো?’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইঠুন নেওয়াজ বলেন, ‘ঢাকার পরিবহন খাতে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার দায়ভার অতীতের সব রাজনৈতিক সরকারের। তারা পরিবহন মালিকসহ খাত সংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের অনিয়ম করার সুযোগ দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের নগর পরিবহন ব্যবস্থার চিত্রটি এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন, লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো ঢাকায় চলাচলের জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে যাতায়াতের মেরুদণ্ড হওয়ার কথা থাকলেও এসব বাস পরিণত হয়েছে জনদুর্ভোগের কেন্দ্র হিসেবে। আমি মনে করি, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাটি পুরোপুরি ঢেলে সাজানো দরকার। এজন্য সরকারের উচিত হবে রাস্তায় থাকা সব বাস অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বা নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে সেগুলো পরিচালনা করা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এমন উদ্যোগের কথা শুনে এলেও এখন পর্যন্ত সেটির বাস্তবায়ন দেখিনি।’

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, খোদ রাজধানীর ওপর দিয়ে যদি প্রতিনিয়ত শত শত অবৈধ যানবাহন চলাচলের সুযোগ পায়, তাহলে সারাদেশের পরিস্থিতি কতটা নাজুক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জনস্বার্থে অতিদ্রুত এসব অবৈধ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরুর তাগিদ দেন তিনি।

সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারানো জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং পরিবেশ রক্ষায় রাজপথে সোচ্চার নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, অবৈধ বাস চলাচল করায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে বহু মানুষ আহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক প্রাণহানিও হচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশ অবৈধ বাসের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ নেই। তাদের দক্ষতার যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি রয়েছে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালান না। ফলে রাজধানীর যানজট নিরসনে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন দুর্ঘটনাবিরোধী অধিকারকর্মী নিখিল ভদ্র।

ভোরের আকাশ/ সু