লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও নোয়াখালীর হাতিয়ার মূর্তিমান আতংক ফরিদ ডাকাত। হাতিয়া আ. লীগের এমপি মোহাম্মদ আলীর পালিত ডাকাত ফরিদ এখন বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে গত দুই মাসে মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ,অপহরণ, মাছঘাট দখল, ডাকাতি, লুটপাট ও ফরিদের অস্রধারী ডাকাত বাহিনী কামিয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তোলা হচ্ছে চাঁদা, পুলিশ ফাঁড়ি এখন ডাকাতদের রান্নাঘর। ফরিদের অস্রধারী বাহিনীর তান্ডবে দিশেহারা হয়ে পড়েছে রামগতির বয়ারচরের ব্রীজঘাট, পতগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকার মানুষ।
শেখ ফরিদ (ফরিদ ডাকাত) লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। রামগতির দুর্গম বয়ারচরের মূর্তিমান আতংক ডাকাত খোকনের সেকেন্ড ইন কমান্ডার হিসেবে কাজ করতেন। পরে নিজেই একটি বাহিনী তৈরী করে নাম রাখলেন ফরিদ বাহিনী। ওই বাহিনীর লিডার হিসেবে আছেন ফরিদ ডাকাত। রামগতির চরগাজী ইউনিয়নের মেম্বার হলেও ভবিষ্যতে হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য রামগতির টাংকিরঘাট এলাকাটি হাতিয়ার এমপি মোহাম্মদ আলীর হাতে তুলে দেয় ফরিদ। বিনিময়ে পাবেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এমপি মোহাম্মদ আলীর এমন আশ্বাসে রামগতির ভোটার হয়ে জায়গাটি হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নের নামে গেজেট অন্তভূক্ত করান ফরিদ। টাংকিরঘাট, সেন্টাল মার্কেট ও তেগাছিয়া পর্যন্ত বয়ারচরের এই অংশটি রামগতি ও হাতিয়া দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী। সীমান্তবর্তী হওয়ায় প্রশাসনও এখানে ভালোভাবে কাজ করতে পরেন না। বছর দুয়েক আগে টাংকি বাজার পুলিশ ক্যাম্প পরিদর্শনে আসলে রামগতি থানার ওসি ও সার্কেল এসপিকে ফরিদ বাহিনী ৩ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে।
৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর রামগতির চরগাজী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাইফুল ইসলাম ও হাতিয়া বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের সমর্থিত হরনী ইউনিয়ন বিএনপির কিছু স্থানীয় নেতার সেল্টারে ফরিদ ডাকাত বেপরোয়া হয়ে উঠে। শুরু হয় ফরিদের সেই তান্ডব। চরের নিয়ন্ত্রণ নিতে দুর্গম বয়ারচরে বেপরোয়া দাবিয়ে রেখেছে ফরিদের বাহিনী। একের পর শুরু হয় তার দখল ও চাঁদাবাজির মহোৎসব। শেখ হাসিনার ভারত চলে যাওয়ার পর শেখ ফরিদ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে শুরু করেন চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, চরের জমি দখলসহ অভিযোগের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। তাঁর অপকর্মের সহযোগী ৫ ভাইসহ ৪০ জন ডাকাত। সবার হাতে রয়েছে অবৈধ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতনের স্টিমরোলার। ফরিদের নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে রামগতির চরগাজী, বয়ারচরের তেগাছিয়া, ব্রীজঘাট ও টাংকিরঘাট এলাকা। তার চোখরাঙানিতে আ.লীগের সকল নেতাকর্মী এলাকাছাড়া। মেঘনা নদীতে অনেকটা নির্বিঘ্নে চলছে ফরিদের ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ‘রাজত্ব’। এসবই ফরিদ ও তাঁর ৪০ অনুসারী করে বলে সূত্র জানায়।
সম্প্রতি ফরিদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোঃ জহির উদ্দীন বাদী হয়ে রামগতি থানা ও সেনা ক্যাম্পে পৃথক পৃথক দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।
ফরিদ বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বয়ারচরের টাংকিরঘাট, তেগাছিয়া ও ব্রীজঘাট এলাকার প্রায় ২ শতাধিক পরিবারের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে ফরিদ ও তার বাহিনী। এর মধ্যে টাংকিরঘাট এলাকায় ২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে ফরিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। তাদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ জন। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা ২০ জন। প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ১৫টি বসতবাড়ী। লুট করা হয়েছে তেগাছিয়া, ব্রীজঘাট ও টাংকিরঘাটের প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান। লুটকরা দোকানগুলো এখন ফরিদ বাহিনীর আড্ডার ক্লাব। ৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যরা সরিয়ে যাওয়ার পর ২টি পুলিশ ফাঁড়ীতে ডাকাতদের রান্না বান্নার কাজ চলছে। এসব অরাজকতার প্রধান হোতা ফরিদ বাহিনীর প্রধান ফরিদ ডাকাত।
এর আগে তিনি আ.লীগ নেতা হাতিয়ার এমপি মোহাম্মদ আলীর কুখ্যাত ডাকাত সর্দার খোকন ডাকাতের ছত্রছায়ায় এলাকায় প্রকাশ্যে এসব কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ৫ আগস্ট থেকে নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে আ.লীগ ট্যাগ দিয়ে হামলা,ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, জমি দখল, বসতবাড়ী দখল, মাছঘাট দখল ও মুক্তিপণ আদায় করা হয়। ৫ আগস্ট রাত থেকে ২ শতাধিক অস্রধারী ডাকাত দলকে হাতিয়া থেকে রামগতির বয়ারচরের তেগাছিয়া এলাকায় নিয়ে আসেন ফরিদ কমান্ডার।
তার বিশাল এই ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা হলেন-বাদশাহ ডাকাত, ভুট্টু ডাকাত, ফজলু ডাকাত, আলমগীর ডাকাত, হোসেন ডাকাত ও আওলাদ সহ প্রায় অর্ধশতাধিক ডাকাত দল। ফরিদ ডাকাতের ৮ ভাইয়ের মধ্যে ৫ ভাই আনসার সদস্য। তারা রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে বেপরোয়া চাঁদা তুলছে।
ডাকাত ফরিদের নির্মমতার ইতিহাস বেশ পুরনো ২০০১ সালে একটি চর দখলকে কেন্দ্র করে ফরিদের ভাই সোলইমান কমান্ডার, ডাকাত জাহাঙ্গীর বাহিনীর মধ্যে তেগাছিয়া বাজারের গোলাগুলিতে জাহাঙ্গীর বাহিনীর ১৫ জন নিহত হয়। ফরিদও সেখান অস্ত্রদারি ছিল। ফরিদের ৮ ভাইয়ের মধ্যে ৫ ভাই আনসারের ট্রেনিং নিয়ে চাকরি না করে এলাকায় করেন ডাকাতি। তারা সবাই ফরিদের সেকেন্ড ইন কমান্ডার। এছাড়া ওই বছরে ওই এলাকায় প্রতিপক্ষের ১৬ জনকে একসাথে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে ডাকাত ফরিদ ও তার বাহিনী।
২০১৬ সালে তেগাছিয়া এলাকায় অভিযান চালাতে গেলে র্যাব সদস্যদেরকে মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে হামলা চালায় ফরিদ ও তার বাহিনী। সে হামলায় ৪ জন র্যাব সদস্যকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সে সময় ফরিদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নির্দেশ থাকলেও হাতিয়ার এমপি মোহাম্মদ আলীর হস্তক্ষেপে ছাড়া পান বলে জানান স্থানীয়রা। মূলত ফরিদকে হরনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানানোর প্রলোভন দিয়ে হাতিয়ার এমপি মোহাম্মদ আলী রামগতির টাংকিরঘাটটি হাতিয়ার দখলে নিয়ে নেন।
এসব হত্যার ঘটনা ছাড়াও ফরিদ ডাকাত ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে রামগতি, হাতিয়া ও চরজব্বর থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অস্র সহ বেশ কয়েকবার আটক হয়েছেন ফরিদ ও তার বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু আ.লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী এমপির লবিং ও তদবিরে বার বার ছাড়া পেয়ে যায় ফরিদ। ছাড়া পেয়ে শুরু করে আবারও তান্ডব। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত টাংকিরঘাট, তেগাছিয়া ও ব্রীজঘাট এলাকা থেকে ৪৮১ টি গরু চুরি করেছে ফরিদ ও তার বাহিনী। ফরিদ বাহিনীর অত্যাচার ঠেকাতে রামগতির তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকায় দুটি পুলিশ ফাঁড়ী স্থাপন করা হয়। এতে কিছুটা তান্ডব কমলেও গত ৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় আবারও বেপরোয়া তান্ডবলীলা। আ.লীগের খোলস পাল্টিয়ে রাতারাতি বিএনপির নেতা পরিচয়ে শুরু করেন নারকীয় তাণ্ডব। ওই সব এলাকার দোকানপাট, মাছের আড়ত,বসতবাড়ি ও জমি দখল করে কামিয়েছে দুই কোটি টাকা। বিভিন্ন দোকান থেকে লুট করা হয়েছে অন্তত দেড় কোটি টাকার মালামাল। দখল করেছে বয়ারচরের টাংকিরঘাট ও ব্রীজঘাটের কোটি কোটি টাকার মাছ ধরার ট্রলার।
ফরিদ কমান্ডারের অন্যতম সহযোগী আলমগীর ব্যাপারীর নেতৃত্বে ৪০০ শ মাঝির কাছ থেকে বিএনপির নেতাদের নামে তোলা হচ্ছে ৩০০ টাকা করে চাঁদা। চাঁদাবাজি থেকে বাদ যায়নি জাল টানা দরিদ্র জেলেরাও, প্রত্যেক জেলেকে দিতে হচ্ছে দৈনিক ৫০ টাকা করে চাঁদা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন রামগতি ও হাতিয়ার সিমান্তবর্তী বয়ারচর এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুখ খুলছেনা কেউ। কারণ: গোটা চর এলাকা এখন ফরিদ ও তার বিশাল ডাকাত বাহিনীর অস্ত্রের ভয়ে তটস্থ।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির ইজেম করেছে ক্ষুন্ন। সরেজমিনে গিয়ে মিলছে এসব তথ্য। এমতাবস্থায় বয়ারচরে দ্রুত যৌথবাহিনির ক্যাম্প স্থাপন করে এসব অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান স্থানীয়রা।
অভিযুক্ত ফরিদ বিশেষ ব্যবস্থায় মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত না। ৫ তারিখের পর বাচ্চু চেয়ারম্যানরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে আমার অফিসও ভাংচুর করছে। তাই বাচ্চু চেয়ারম্যানের অপকর্ম প্রতিহত করছি আমরা। হাতিয়া ও সুবর্ণচরের লোকজন আমাদের বয়ারচরে তান্ডব চালাতে আসলে আমি জনগনকে সাথে নিয়ে প্রতিহত করছি। এখনতো যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। এই সুযোগে তারা আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দিচ্ছে।
বিএনপির নেতা মীর আক্তার হোসেন বাচ্চু বলেন, ফরিদের তান্তবলীলায় গোটা বয়ারচর এখন এক আতংকের নাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না থাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে ফরিদ আলাদাভাবে শাসন করছে বিশাল এই চরে। এমন কোন অপকর্মে নেই, যা ফরিদ ও তার বাহিনী করেনি।
হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী গ্রেপ্তার থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রামগতি থানার ওসি মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দিন বলেন, দুর্গম বয়ারচরে ফরিদ বাহিনী শাসন করে বেপরোয়া তান্ডবলীলা চালানোর খবর আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ চলছে।অচিরেই যৌথ বাহিনী বয়ারচরে অভিযান পরিচালনা করবে। আমরা সবকিছু প্রসেসিং করছি।
ভোরের আকাশ/ সু