logo
আপডেট : ২ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৩০
হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স উপস্থিতি বাড়ায়, বেড়েছে সেবার মান
সিন্ডিকেট ভাঙতেই বদলে গেল চিকিৎসাসেবা
শিপঙ্কর শীল

সিন্ডিকেট ভাঙতেই বদলে গেল চিকিৎসাসেবা

  • ঢামেক হাসপাতাল ল্যাবে দৈনিক ৫০০-৬০০ জনের স্থানে এখন ১২০০-১৩০০ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে
  • সব হাসপাতালেই বেড়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
  • বেসকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমিশন নেওয়া হতো
  • মোটা অংকের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট
  • দালালচক্রের অনেকই পলাতক, রোগী হয়রানি কমেছে


ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে এ বিভাগে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানাগেল ভয়ঙ্কর তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্যাথলজি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানালেন, চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট কমিশনের লোভে যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার কথা বলে রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে শারীরিক পরীক্ষার পাঠিয়ে দিতেন। ওইসব হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে পাওয়া ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমিশন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন। এতে করে মাস শেষে কমিশন বাণিজ্য থেকে বড় অংকের টাকা পেতেন সবাই। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর ওই সিন্ডিকেট ভেঙে যায়। দালালচক্রের কেউ কেউ পলাতক। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে এলেও ডিউটি করে চলে যায়।

এ অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট (বিভাগীয় ইনচার্জ) ডা. শায়লা শারমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আগের তুলনায় বেড়েছে উল্লেখ করে শায়লা শারমিন ভোরের আকাশকে বলেন, আগে এই ল্যাবে দৈনিক পরীক্ষা হতো ৫০০ থেকে ৬০০ জনের। এখন দৈনিক পরীক্ষা হয় ১২০০ থেকে ১৩০০ জনের। অর্থাৎ গড়ে মাসে টেস্টের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিদায়ী সরকারের আমলে এই সংখ্যা থাকতো প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজারের মধ্যে। এখানে যারা টেকনোলজিস্ট আছেন তারা খুবই প্রেসারে মধ্যে আছে। প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। আমরা সাধ্যমত সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

শুধু ঢামেক হাসপাতাল নয়, সব সরকারি হাসপাতালেই একই চিত্র। সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার বেশ উন্নতি হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসাধু চক্রের সিন্ডিকেট। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার হার বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারি হাসপাতালে আগতদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করাতে যাওয়ার ঘটনা কমেছে। প্যাথলজি, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে উপচেপড়া ভিড়। মিলছে প্রায় সব ধরনের ওষুধ। চিকিৎসক ও নার্সের উপস্থিতি নজর কেড়েছে সকলের। চিকিৎসকদের সাক্ষাৎ পাওয়া এবং নামমাত্র ফি দিয়ে পরীক্ষা করাতে পেরে খুশি রোগী ও তাদের স্বজনেরা।

আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি চিকিৎসাসেবার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অসাধু চক্রের হাতে। ওই সময়ে চিকিৎসাসেবার মান হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা পেতে ভিড় করা দরিদ্র মানুষ সরকারি হাসপাতালে ভিড় করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শয্যা মিলত না। আবার শয্যা পেলেও ওষুধ কিনতে হত বাইরের ফার্মেসি থেকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিংহভাগ করাতে হতো বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে। সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং ভর্তি রোগীদের অধিকাংশ টেস্ট বাইরে গিয়ে করাতে হয়েছে। রোগীদের জন্য সরবরাহকৃত বিনামূল্যের ওষুধ বাইরে পাচার হয়ে যায়। দালালচক্রের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালের রোগী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনাও স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। চিকিৎসক, নার্সদের উপস্থিতির হার ছিল তলানিতে। সব মিলিয়ে বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবার আড়ালে চলে রোগী হয়রানি এবং অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের অসাধু ব্যবসা। মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ম ও রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করার কারণেই সরকারি হাসপাতালের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিযোগ অনেকের। মধ্যস্বত্বভোগীদের তালিকায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, আয়া, ট্রলিম্যান, ওয়ার্ড বয়সহ অনেকেই রয়েছেন। সব মিলিয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পদে পদে অশেষ ভোগান্তি শিকার হতেন চিকিৎসাপ্রার্থীরা।

চিত্র পাল্টে গেল যেভাবে

রাজধানীর সরকারি হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত দুই মাসের ব্যবধানে পাল্টে গেছে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার চিত্র। রোগীবান্ধব পরিবেশে স্বস্তিতে রোগী ও স্বজনেরা।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ল্যাব থেকে তিনটি টেস্ট রিপোর্ট হাতে নিয়ে যাচ্ছেন মো. সোবহান। তিনি ভোরের আকাকে জানান, টেস্ট করাতে সাময়িক দুর্ভোগে পড়েছি। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে যেতে হয়নি। বাইরে করাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হতো। এখানে এক হাজার টাকার মধ্যেই হয়ে গেছে বলে জানান মো. সোবহান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবের সামনে রক্ত পরীক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন রিপা আক্তার (২৫)। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, আগে রোগীদের সিরিয়াল এগিয়ে দেওয়ার জন্য আনসারদের টাকা দিতে হতো। এখন কোনো ধরনের টাকা দিতে চাইলে তারা টাকা নিতে চায় না বলে জানান রিপা আক্তার। পাশে দাঁড়ানো মো. আরাফাত ইসলাম (৪৫) বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সব পরীক্ষা হচ্ছে। দুর্ভোগ কমেছে। কেউ সিরিয়াল ভাঙছে না। কোনো অসুবিধা হলে সেনাবাহিনী ঠিক করে দিচ্ছে বলে জানান আরাফাত ইসলাম।

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেনুয়ারা বেগম (৬০)। বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে হাটুতে আঘাত পেয়েছেন তিনি। হুইল চেয়ারে বসে আছেন তিনি। তার সঙ্গে আছে মেয়ে শারমিল শিলা (২৪)। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, আগে রোগীদের অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সেবা নিতে রোগীদের অনেক কষ্টও হত। এখন তা কমেছে। পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে না।

এ বিষয়ে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এর সিনিয়র টেকনোলজিস্ট মো. দেলোয়ার হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আগের তুলনায় পরীক্ষার হার বাড়ছে। দালালদের দৌরাক্ততা নেই। আগে তাদের মাধ্যমে অনেক রোগী পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরে চলে যেতেন। এখন ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নামমাত্র ফি হওয়ায় রোগীদের চাপ বেশি। তবে পরীক্ষা না করিয়ে কেউ ফিরে যাচ্ছেন না বলে জানান মো. দেলোয়ার হোসেন।

চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আগত রোগী ও তাদের স্বজনেরা। চোখের ছানি অপারেশনের জন্য এসেছেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মো. কাশেম মিয়া। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, চলতি বছরের শুরুতে আমি চোখের সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু অপারেশন করানোর সিরিয়াল পাইনি। গত কয়েকদিন ধরে নামমাত্র ফি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছি। বাইরে যেতে হয়নি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অপারেশনের সিরিয়াল পেয়ে যাবো বলে জানান মো. কাশেম মিয়া।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট (বিভাগীয় ইনচার্জ) নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা করাতে আসা রোগী আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আমাদের ওপর চাপও বেড়েছে। সকলের সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি আমরা। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে দালাল প্রবেশে কঠোর অবস্থানে কর্তৃপক্ষ।

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নাদিয়া শারমিন ভোরের আকাশকে বলেন, আগের তুলনায় টেস্টের হার বেড়েছে। আগে ৫০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে রোগীদের সিরিয়াল নিয়ে দিতো একটি চক্র। এখন তাদের চোখে পড়ে না। তাদের বিচরণও কমে গেছে।

চিকিৎসাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোকসানা জানান, আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হয়েছিলাম। আমি ২৫-৩০ দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি আছি। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দুই-তিন দিনের মধ্যে চলে যাব। আমার সব পরীক্ষা ঠিক মতো হচ্ছে বলে জানান রোকসানা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার প্রশংসা রোগী ও স্বজনদের মুখেই শোনা যাচ্ছে। সেবা নিশ্চিতকল্পে মনিটরিং টিম কাজ করছে। সরকারি ওষুধ পাচার রোধকল্পে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীদের যাতে বাইরে গিয়ে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন না পড়ে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। হাসপাতালের শৃঙ্খলা ও সেবার মান বেড়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসাধু চক্রের সিন্ডিকেট। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার হার বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারি হাসপাতালে আগতদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করাতে যাওয়ার ঘটনা কমেছে। প্যাথলজি বিভাগে উপচেপড়া ভিড়। মিলছে প্রায় সব ধরনের ওষুধ। স্বাস্থ্যসেবার মান বজায় রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

ভোরের আকাশ/ সু