logo
আপডেট : ২ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৫৫
ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও সমাধান
অনুপম হীরা মণ্ডল

ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও সমাধান

১. ভবদহের পরিচিতি
কোনো উপজেলা নয়, এমনকি ইউনিয়নও নয়, তবে ভবদহ নামটি এখন দেশে-বিদেশে পরিচিত। পরিচিতি ঘটেছে ‘জলাবদ্ধতা’ নামক বিপর্যয়ের কারণে। ‘ভব’ অর্থ পৃথিবী আর ‘দহ’ অর্থ নদীর মধ্যে সৃষ্ট ঘূর্ণি। যেখানে নদীর সংযোগ কিংবা স্রোত এসে মেলে সেখানে প্রবল স্রোতের ফলে ঘূর্ণি তৈরি হয়। স্থানীয় ভাষায় একে ‘দহ’ বা ‘দোয়া’ বলে। ভবদহ নামকরণ নদীর এই ঘূর্ণি থেকে। কথিত আছে যে, মাত্র অর্ধ শতাব্দী আগেও এখানে নদীর ঘূর্ণিতে যে শব্দ হতো তা চার-পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেত। এই ঘূর্ণির পাশ দিয়ে কেউ নৌকা নিয়ে যাওয়ার সাহস করত না। যদি কখনো নৌকা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ত তবে নৌকাসহ আরোহী সবার সলিল সমাধি ঘটত। মাত্র অর্ধশত বছরের মাথায় ওই নদী এখন মৃত। ঘূর্ণি তো দূরের কথা এক কালের প্রমত্তা ওই নদী এখন পরিত্যক্ত নালায় পরিণত হয়েছে। এখন নদীবিধৌত অঞ্চলের বাসিন্দারা ভয়াবহ জলাবদ্ধতার দুর্যোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। অথচ এখানে একসময় কৃষিকেন্দ্রিক একটি স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি সক্রিয় ছিল।

এই জনপদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে। পনের লাখের বেশি মানুষের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ব্যাহত। বসতবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, মসজিদ-মন্দির – সব পানিতে তলিয়ে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। যশোর জেলার মণিরামপুর, অভয়নগর, কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার অধিকাংশ অঞ্চল, যা ভবদহ নামে পরিচিত, তা আজ জলাবদ্ধতায় বিপন্ন। অথচ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সমৃদ্ধশালী এই জনপদটি সম্পূর্ণভাবে মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে পতিত।

২. উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প
ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার কারণ মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এখানে সরকারি, বেসরকারি, দেশি, বিদেশি অধিকাংশ উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়েছে প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক পরিবেশ-প্রতিবেশকে অস্বীকার করে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ তথাকথিত উন্নয়ন চিন্তা আজ বাস্তবতা বিবর্জিত বলে প্রমাণিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে গ্রহণ করা কৃত্রিম ও অদূরদর্শী উন্নয়ন চিন্তাই আজ ভবদহ অঞ্চলের মানুষের টিকে থাকার প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই এলাকার মানুষ ধীরে ধীরে পরিবেশ-উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই অঞ্চলে বড় ধরনের উন্নয়নের সূত্রপাত গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। এ সময় মার্কিন সহযোগিতায় উপকূল অঞ্চলের ব্যবস্থাপনায় একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। মার্কিন সরকারের সহযোগিতায় পাকিস্তান সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI) উফশী ধানের জাত তৈরি করেছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশকের গবেষণা ও উৎপাদনে সফলতা এসেছে। মার্কিন সরকারের কাছে ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে নতুন উন্নয়ন ধারণা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার নতুন চ্যালেঞ্জ। মার্কিন কর্তারা নতুন স্লোগান নিয়ে এসেছেন, ‘অধিক খাদ্য ফলাও, মানুষ বাঁচাও।’ তখন বহু দেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত। অনেক দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সবুজ বিপ্লবের জন্য কৃষি জমি দরকার। ধান বীজ, সার, কীটনাশক বিক্রির নতুন বাজার দরকার। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তখন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে নির্বাচন করে। এ দেশের উপকূল অঞ্চলজুড়ে নতুন কৃষি জমি তৈরির কাজ শুরু হলো। তখন যৌথভাবে শুরু হয় উপকূল ব্যবস্থাপনা ও কৃষিজমি সৃষ্টির চেষ্টা।

১৯৫৮ সালের ১৬ মে পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান মশিয়াহাটীতে আসেন। ভবদহ অঞ্চলের বিল বোকড় ও বিল কেদারিয়ার মাঝখানে মশিয়াহাটীর অবস্থান। তখন মশিয়াহাটীর পোড়াডাঙ্গা নিবাসী শরৎচন্দ্র মজুমদার পাকিস্তানের মন্ত্রী। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি তোলেন উপকূল অঞ্চলে যে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ও সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে ওই কর্মযজ্ঞের মধ্যে তার অঞ্চলটিকেও যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ ১৯২২ সালের বন্যার পর ভৈরব নদ থেকে মুক্তেশ্বরীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যায়। এর পরবর্তীতে ১৯৩৫-৩৬ সালে মুক্তেশ্বরীর পানি কপোতাক্ষে প্রত্যাহারের ফলে ৪০-এর দশক থেকে মুক্তেশ্বরীর নিম্নাংশ ভবদহ এলাকায় অভয়নগর, মণিরাপুর ও কেশবপুরের পূর্বাংশ তীব্র লবণাক্ততার শিকার হয়। পাহাড়গলা মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই অঞ্চলে লবণ পানি প্রবেশ করে এবং বিলগুলোতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। এ সময় ভবদহ অঞ্চলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

ভারতবিভক্তির পর এই অঞ্চলের কৃষকেরা বেশ সংকটের মধ্যে পতিত হন। তৎকালীন পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত পূর্ব-বঙ্গে একটি নতুন সরকার গঠিত হয়। ওই সরকার পূর্ববঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন নামে ১৯৫০ সালে একটি আইন পাস করে। ওই আইনের খসড়া ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ বিলটির খসড়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালের ১৬ মে আইনটি আইনসভায় পাশ হয়। এর ফলে জমিদারি প্রথা রহিত হয় এবং সমস্ত সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি বলে পরিগণিত হয়। আইনটি পাশ হওয়ার আগে থেকেই রাজনৈতিক মহলে এর আভাস পাওয়া যায়। ফলে জমিদাররা ১৯৪৭ সালের আগেই পূর্ব-পাকিস্তান ছেড়ে যেতে শুরু করেন। ফলে ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলোতে যাদের কর্তৃত্ব ছিল তারা সবাই ভারতের অভিবাসী হয়ে যান। তারা একসময় খাজনা আদায়ের লোভে প্রজাহিতৈষি কর্মকাণ্ড বিশেষ করে বাঁধ তৈরির কাজ করত। জমিদারগণ নিজ নিজ অঞ্চলের কৃষকদের বাঁধ তৈরি করার কাজে সহযোগিতা করত। জনগণ লবণ পানি রোধ করতে কখনো অষ্টকাসী, কখনো ষান্মাসিক বাঁধ তৈরি করত। আবার বর্ষার সময় মিষ্টি পানির প্রবাহ এলে বাঁধ কেটে দিত। বিলগুলোতে ওই সময় যেহেতু সবই আউশ আর আমন ফসল হতো তাই ফসল রক্ষার্থে বাঁধ দেওয়া ছিল অবশ্য কর্তব্য। তা না হলে লবণ পানি এসে ফসলের ক্ষতি করত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর ওই অঞ্চলের কৃষকেরা কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে যখন উপকূল অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয় তখন থেকেই ভবদহ অঞ্চলের কৃষকেরা সরকারের কাছে নানাভাবে এই অঞ্চলের নদীগুলোতেও বাঁধ দিয়ে লবণ পানি বোধ করার একটা জোর দাবি তোলেন।

উপকূল অঞ্চলে কোস্টাল ম্যানেজমেন্টের অধীনে ভবদহ অঞ্চলে বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৬১ সালে এই অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পরামর্শে পাকিস্তান সরকার মুক্তেশ্বরী নদীর ভাটির দিকে হরিনদীর ভবদহ নামক স্থানে নদীর মাঝ বরাবর ০৯ ভোল্ট ও ২১ ভোল্টের দুটো স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। ভবদহ অঞ্চলের এই বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ ছিল বৃহৎ এক কর্মযজ্ঞের অংশ। একই কর্মযজ্ঞের লক্ষ্যে যশোর-খুলনা অঞ্চলে ২৮২টি স্লুইস গেট, ৩৭টি পোল্ডার ও ১৫৫৬ কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ধান ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি। স্লুইস গেট নির্মাণের সময় গড়ে নদীর তলদেশ থেকে স্লুইস গেটের তলদেশ ৫০ ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়। ফলে অল্প দিনের মধ্যে নদীগুলোতে পলি ভরাট হয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যায়। পরবর্তীতে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি নদী পথে সাগরে যেতে না পেরে জনপদে উঠে যায়।

৩. নদী প্রবাহের প্রতিবন্ধক সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ
তৎকালীন যশোরের জমিদার (বর্তমান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ) কালীপদ দত্ত (কালীবাবু) প্রজাদের যোগাযোগের সুবিধার জন্য গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড পুনর্নিমাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪৪ সালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে যশোর হয়ে কলকাতা পর্যন্ত শেরশাহ নির্মিত সড়কটি পুননির্মাণ করেন। এটা করতে গিয়ে তিনি অনেক নদীশাসন করেন। এরপর ১৮৬০ সাল থেকে কলকাতা থেকে পূর্বগামী যশোর হয়ে খুলনা ও গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের এই উদ্যোগের ফলে অনেক উঁচু করে মাটি ঢালা হয়। এতে নদীশাসন করার সঙ্গে সঙ্গে নিম্নভূমি ও বিল অঞ্চলেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। কেবল কলকাতা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৩৮টি রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। এরপর খুলনা ও গোয়ালন্দ পর্যন্ত আরও অজস্র সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতুগুলো ছিল খুবই সংকীর্ণ। ওইসময় রেলসেতুগুলো খুব বেশি বড় করা হতো না। এতে পানি প্রবাহে প্রচণ্ড প্রতিকূলতা তৈরি হয়। ব্রিটিশ সরকারের রেল বিভাগের এই বিশাল কর্মযজ্ঞসহ নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যমুনা, কপোতাক্ষ, ভৈরব, হরিহর, মুক্তেশ্বরী, কালিন্দী, ইছামতি, নাওভাঙ্গা, ব্রেতাবতীসহ (বেতনা) নানা নদী ও তার শাখা-প্রশাখায় প্রবহমান স্রোত ধারার ওপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

পরবর্তীকালে সরকারিভাবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে যুদ্ধের প্রাক-প্রস্তুতির জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার থেকে যশোর জেলাও বাদ যায়নি। ১৯৩৫ সালে কলকাতা-যশোর সড়কপথে নদীর ওপর একাধিক সেতু নির্মাণ করা হয়। সেতু নির্মাণ করার উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর গাড়ি সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। সেতু নির্মাণ করার জন্য অনেকগুলো নদী ও খাল শাসন করে সংকীর্ণ করা হয়। সেতুগুলোর মধ্যে যশোর শহরের ভৈরব নদের ওপর নির্মিত দড়াটানা সেতু, নীলগঞ্জ সেতু অন্যতম। এসব সেতুর দৈর্ঘ ২৫ ফুটেরও কম। অথচ ভৈরবের প্রস্থ তৎকালীন সময়েই প্রায় ৩০০ ফিটের মতো। কোথাও কোথাও তারও বেশি। ফলে সেতু তৈরি করার জন্য নদীকে সংকুচিত করে প্রায় মেরে ফেলার মতো ব্যবস্থা করা হয়। এতে নদীর নাব্যতা কমে যায় এবং ধীরে ধীরে নদী অকার্যকর হয়ে পড়ে। একই বছর যশোর শহরের পশ্চিম পাশে সেনানিবাস ও বিমান বন্দর নির্মাণ করা হয়। এর জন্য মুক্তেশ্বরী নদীকে ভরাট করা করে ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়। নদীর বুকে স্থাপনা ও ক্যাম্পাস নির্মাণ করায় বন্যার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই সম্ভাবনা থেকে স্থাপনাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বুকভরা বাওড় থেকে হালসার খাল কেটে হরিহল উৎস মুখে কপোতাক্ষে প্রবাহিত করা হয়। এতে পরিকল্পিতভাবে মুক্তেশ্বরী নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যাতে নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়।

এর ঠিক তিন বছর পর ১৯৩৮ সনে দর্শনায় গড়ে তোলা হয় কেরু এন্ড কোম্পানি নামের চিনি কল। চিনি কলের জন্য প্রচুর জমির প্রয়োজন পড়ে। তখন ভৈরব নদের বাঁক ভরাট করা হয়। একটি সচল নদীকে এমনভাবে ভারাট করা হয় যে, তার বুকেই গড়ে ওঠে চিনিকল আর দর্শনা রেলস্টেশন। এই নদীর বাঁক ভরাট করায় নদীটির স্বাভাবিক চলশক্তি রহিত হয়। নদীটি দর্শনা রেলস্টেশনের মাত্র দুই কিলোমিটার পশ্চিমে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে কোটচাঁদপুরের ওপর দিয়ে বারোবাজার, যশোর, রাজারহাট, রূপদিয়া, বসুন্দিয়া, শেখহাটি, অভয়নগর, চেঙ্গুটিয়া, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, দৌলতপুর হয়ে খুলনার পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই নদীটি মূলত পদ্মার স্রোত বয়ে নিয়ে আসত। মাত্র অল্পকালের মধ্যে দর্শনা থেকে যশোর দড়াটানা পর্যন্ত একেবারেই মরে যায়। একইভাবে এই মরা নদীর ওপর গড়ে তোলা হয় বিএডিসির কৃষি খামার।

নদীর ওপর খবরদারি এখানেই শেষ নয়। গঙ্গা থেকে উৎসারিত ভৈরব নদ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীয়া জেলার করিমপুর থানার হাগনাগাড়ি নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে নদী দখলের মহোৎসব শুরু হয়। বাংলাদেশের ঝিকরগাছা থেকে সাগরদাঁড়ি পর্যন্ত নদের বেশিরভাগ অংশ ভূমিদস্যুদের কবলে পড়েছে। এমনকি বর্তমানে নদীটি প্রায় বিলীন হওয়ার উপক্রম। এই মহোৎসবের সঙ্গে যুক্ত আছে বাংলাদেশের স্থানীয় ভূমি অফিসের নায়েবরাও। তারা ভূমিদস্যুদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে নদীর জমি ব্যক্তিগতভাবে রেকর্ড দিয়ে দিয়েছেন। এতে অধিকাংশ স্থানে নদ ও নদীর জমি দখল করে স্থাপনা, পুকুর তৈরি করা হয়েছে। যা এই অঞ্চলের নদীর নাব্যতা হারানোর একটি অন্যতম কারণ। এমনকি সরকারি উদ্যোগে হাল আমলে নদী দখলের যে মহোৎসব তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ সাগরদাঁড়িতে পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর উদ্যোগে কপোতাক্ষ বুকে গড়ে তোলা রিসোর্ট ও ইকোপার্ক।

দর্শনার মাথাভাঙ্গা থেকে ভৈরব ও কপোতাক্ষকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এতে কপোতাক্ষ, ভৈরব ও মুক্তেশ্বরীতে পাহাড়ি স্রোত একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো বর্ষা মৌসুমে পদ্মায় অনেক স্রোত তৈরি হয়। কিন্তু ভৈরব, কপোতাক্ষ কিংবা মুক্তেশ্বরীতে ওই স্রোত আসে না। একদিকে ভারতের নদী ব্যবস্থাপনা আর অন্যদিকে বাংলাদেশের ভূমিদস্যুদের নদী দখল এই উভয় কারণে খুব অল্প দিনের মধ্যে এই অঞ্চলের নদীগুলো মরে কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে। চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে ভৈরবের প্রধান শাখা কপোতাক্ষ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে মালঞ্চ নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। কিন্তু মাথাভাঙ্গা আজও স্রোত বয়ে নিয়ে এলেও কপোতাক্ষ ও ভৈরব মাথাভাঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং এই স্রোতস্বিনী দুটো পাহাড়ি জলধারা থেকে বঞ্চিত। কেউ কখনো এই দুটো নদীতে পাহাড়ি জলধারা প্রবাহের ব্যবস্থা করেনি। ফলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ নদীই আজ মৃতপ্রায়। কারণ এর সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে ভৈরব ও কপোতাক্ষের শাখা-প্রশাখা হিসেবে উৎপন্ন।

উজানের দিকে ভৈরব ও কপোতাক্ষ মরে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ নদীই ১৯৩৫ সালের পর থেকে নাব্যতা হারাতে থাকে। এর ফলে নদীবাহিত পলি সাগরের স্রোতে উপরের দিকে চলে এলেও তা মিঠা পানির কোনো চাপ তৈরি করে না। ফলে পলি ধীরে ধীরে নদীবক্ষে পতিত হয়ে নদী ভাটির দিকেও মরে যেতে থাকে। আবার সাগরের কাছেও পলির পতন ঘটে। এতে উপকূল অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনের শ্বাসমূল মরে যেতে থাকে। মিষ্টি পানির স্রোত না থাকায় একদিকে পলির পতন বাড়ে আর অন্যদিকে সুন্দরবন অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্র বাড়তে থাকে। এর ফলে সুন্দরবনের গাছে আগা মরা রোগ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব পড়ে।

নদী শাসনের মাত্রা এই অঞ্চলে আর কখনো থামেনি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের সড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেতু বিভাগ, রেল বিভাগ কেউই নদীর ওপর তাদের অশুভ হস্তক্ষেপ কম করেনি। অপরিকল্পিত সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করে নদী ও বিলগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থা নষ্ট করেছে। এতে পানির প্রবাহ দিন দিন নষ্ট হয়ে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

৪. জলাবদ্ধতার সূত্রপাত
ভবদহ অঞ্চলে প্রথম জলাবদ্ধতার সূত্রপাত হয় আশির দশকে। মাত্র ১৯ বছরের মধ্যে প্রমত্তা নদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে উজানের পানি সাগরে যেতে পারে না। পলি পড়ে নদী তো ভরাট হয় উপরন্তু স্লুইস গেটগুলো অকেজো হয়ে যায়। স্লুইস গেট দিয়ে পানি প্রবেশ করতে না পারার বড় কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। নদীবিধৌত পলিকে বাধা দিয়ে নিম্নভূমি তথা বিলে পতনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি। এর ফলে পলি নদীতে পতিত হয়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া। জলাবদ্ধতার ভয়বহতা পরিলক্ষিত হয় ১৯৮৬ সালে। ভবদহ অঞ্চলের মানুষ অতর্কিত এই জলাবদ্ধতার শিকার হয়। ১৯৮৭ সালে পানি কিছুটা কমলেও ১৯৮৮ সালে আবার ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ সময় ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ৯৮ ভাগ মানুষের ঘর ছিল মাটি ও খড়ের তৈরি। অপ্রত্যাশিতভাবে ৯০ ভাগ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তারা বাঁচার তাগিদে সড়ক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় আশ্রয় গ্রহণ করে। টানা ৮ মাস পানিবন্দি অবস্থায় কাটানোর পর কিছু কিছু মানুষ নিজ ভিটায় ফিরতে পারে বটে কিন্তু সে এক মানবেতর জীবন শুরু হয়। বেঁচে থাকার নতুন এক যুদ্ধ শুরু হয়। তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করে জলাবদ্ধতা দূর করার আশ্বাস দেন। তবে কোনো সরকারের আমলেই এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করার কোনো উল্লেখযোগ্য স্থায়ী সামাধান অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করা যায়নি। দিন যতই গড়াতে থাকে ভবদহের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ভূমির অবনমন। ভবদহ অঞ্চলের নদীগুলোর তলদেশের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মানুষের সমস্যা ও সংকট।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ যাবৎ যত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার বেশিরভাগ কর্মসূচি ছিল আপাত সমাধানমূলক। এতে গুরুত্ব দেওয়া হয় খনন যন্ত্র দিয়ে নদী খননে। প্রতিবছর নানা পাইল প্রকল্পের মাধ্যমে নদী ও খাল খনন করা হয়। নদী খননের এসব প্রকল্পকে ভুক্তভোগী জনগণ কখনো ভালো চোখে দেখেনি। তাদের যুক্তি ছিল, ‘নদী কখনো খনন করে বাঁচানো যায় না, নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হয়। না হলে নদী আপনি মরে যায়।’ এই যুক্তির যারা পরিপোষক ছিলেন তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৯৭ সালের ২৯ অক্টোবর ভরত ভায়না নামক স্থানে ভায়না বিলের বাঁধ কেটে দেয়। এতে জোয়ারের তোড়ে নদী আপনা আপনি ১৮ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়ে যায়। নদী গড়ে ১২ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়। বিলের তলদেশে গড়ে এক মিটারের বেশি পলি পড়ে উঁচু হয়। নদীর মুখে বিল উঁচু হয় আড়াই মিটার এবং শেষের দিকে বিল উঁচু অর্ধমিটারের কিছু বেশি। পরবর্তীতে দেখা যায় সব বিল জলাবদ্ধতার শিকার হলেও ভায়নার বিলের কৃষকেরা ফসল ফলাতে পারছেন। যারা ভায়নার বিলের বাঁধ কেটে দিয়েছিলেন তাদের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। এর ফলে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। অনেক কৃষক আত্মগোপনে চলে যান, অনেকে আবার জেল খাটেন। কিন্তু জলাবদ্ধতা দূরিকরণে সাধারণ মানুষের এই প্রাকৃতিক পন্থাকে পানি উন্নয়ন বোর্ড গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কৃষকদের উদ্ভাবিত প্রাকৃতিক এই পন্থাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ডাকজোয়ার’। কৃষকের অভিজ্ঞতা লব্ধ এই ‘ডাকজোয়ার’ প্রথাকেই পানি উন্নয়ন বোর্ড নাম দেয় ‘TRM’ (Tidal River Management)।

ভবদহ জলাবদ্ধতা সমাধান করতে হবে এই প্রাকৃতিক নিয়মেই। জনগণ উদ্ভাবিত এই ‘ডাকজোয়ার প্রথা’র মাধ্যমে এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সব প্রকল্পই গত ৫০ বছর ধরে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেবল ডাকজোয়ার প্রথাকেই উপযুক্ত প্রথা বলে মনে করা যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক

ভোরের আকাশ/রন