- লেবাননে স্থল অভিযান শুরু
- তেল আবিবে হিজবুল্লাহর হামলা
- ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলা
- গাজায় অভিযান জোরদার
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। একযোগে চারটি দেশ- লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও গাজায় হামলা চালিয়েছে দেশটি।
গতকাল মঙ্গলবার লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তবে স্থল অভিযানের পর পিছু হটেছে তারা। এই হামলায় ৯৫ জনের প্রাণ গেছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো। কিন্তু লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলছে, ইসরায়েলি সেনারা তাদের ভূখন্ডে ঢুকতে পারেনি। তারা দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সদর দপ্তর এবং তেল-আবিবে হামলা হামলা চালিয়েছেন। অন্যদিকে ইয়েমেন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এছাড়া ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা জোরদার করেছে তারা। খবর বিবিসি, রয়টার্স ও আল-জাজিরা।
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে আংশিক অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর আগে বৈরুতের শহরতলির বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়। এর অন্তত এক ঘণ্টা পর সেখানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে যে তারা সীমান্তের কাছে লেবাননে হিজবুল্লাহ অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে সীমিত স্থল অভিযান পরিচালনা করছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট উত্তর ইসরায়েলের স্থানীয় কাউন্সিলের প্রধানদের বলেছেন, লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর যুদ্ধের পরবর্তী পর্ব শিগগিরই শুরু হবে। আমরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে (আকাশ, সমুদ্র ও স্থল থেকে) অভিযান চালাব।
লেবাননের একটি নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর অবস্থান থেকে লেবাননের সেনারা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পিছিয়েছে। তবে লেবাননের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার করেননি।
ইসরায়েল এক বিবৃতিতে বলেছে, পুরো লেবাননে এই অভিযান চালানোর ইচ্ছা নেই। আপাতত আংশিক অভিযান চালাতে চায় ইসরায়েলি বাহিনী।
লেবাননে ইসরাইলের নতুন অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন নর্দান অ্যারোস’। ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, হামলাটি চালানো হচ্ছে স্থল ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে। সম্প্রতি হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে দক্ষিণ লেবাননে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গত শুক্রবার বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন নেতাকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। লেবাননে চলমান হামলায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। রোববার এক বিবৃতিতে এমনটা জানিয়েছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি।
তেল আবিবে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: হিজবুল্লাহ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ‘খায়বার’ নামের একাধিক অভিযানের অংশ হিসেবে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। গতকাল সকালে সংগঠনটি জানায়, ‘ও নাসরাল্লাহ! আমরা তোমার সেবায় আছি’ স্লোগান দিয়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দা ইউনিট ৮২০০ এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তেল আবিবের উপকণ্ঠে অবস্থিত গ্লিলট ঘাঁটিতে একাধিক ‘ফাদি-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনবিষয়ক সংবাদমাধ্যম প্যালেস্টাইন ক্রনিকল এ খবর জানিয়েছে।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, তেল আবিবে রকেটের টুকরো পড়ে কমপক্ষে দুই ইসরায়েলি নাগরিক মাঝারি আঘাত পেয়েছে। এছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা আকাশে বাধাপ্রাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো তেল আবিবের উত্তরে রাস্তায় পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরায়েলি দমকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তেল আবিবের উত্তরে কফার সাবার কাছে একটি রকেট পড়লে আগুন ধরে যায়। ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, লেবানন থেকে বৃহত্তর তেল আবিব এলাকার দিকে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, মোট ১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লেবানন থেকে তেল আবিবের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর রকেট হামলার কারণে লক্ষাধিক ইসরায়েলি নাগরিক নিরাপদ আশ্রয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও বাধা দেওয়ার কথাও নিশ্চিত করেছে তারা।
গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে হিজবুল্লাহ সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ নিলেও সীমিতভাবে জড়িত ছিল। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে লেবাননের অংশবিশেষ দখল করে রেখেছে এবং ২০০০ সালে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে লেবাননের প্রতিরোধের মুখে দেশটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ২০০৬ সালে পুনরায় লেবানন দখলের চেষ্টা করলেও ইসরায়েল ব্যর্থ হয়; যা লেবাননের জন্য একটি বড় বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ইসরায়েল এখনও শেবা ফার্মসসহ লেবাননের কিছু অংশ দখল করে রেখেছে; যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।
গাজায় নিহত আরও ৩১: ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আরও বেশি হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এবার বিমান হামলায় অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলা শুরুর হুমকির পর স্থানীয় সময় গতকাল ওই হামলা হয় বলে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপত্যকাটির আটটি শরণার্থী শিবিরের একটি নুসিরাতের দুটি বাড়িতে ইসরায়েলি হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন।
চিকিৎসকদের বরাতে প্রতিবেদন বলছে, গাজা শহরের তুফাহতে একটি স্কুলে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে আরেকটি হামলায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, হামাস জঙ্গিদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা হয়েছে। এটি তাদের ঘাঁটি ছিল। হামাস অবশ্য সেখানে ঘাঁটি গড়ার কথা অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া গতকাল দুটি পৃথক ইসরায়েলি হামলায় দক্ষিণ গাজা উপত্যকার রাফাহ এবং গাজা শহরের জেইতুন শহরতলিতে পাঁচ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উপত্যকাটির দক্ষিণে খান ইউনিসে একটি তাঁবুতে বাস্তুচ্যুত মানুষের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলায় ছয় ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামাসের সশস্ত্র শাখা ইসলামিক জিহাদ এবং তাদের সহযোগীরা পৃথক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা গাজার বেশ কয়েকটি এলাকায় অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট, মর্টার ফায়ার এবং বিস্ফোরক ডিভাইস দিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীকে আক্রমণ করেছে।
সিরিয়ায় হামলা: সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে দখলদার বাহিনীর হামলায় ৩ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৯ জন। সোমবার দ্য সিরিয়ান আরব নিউজ এজেন্সির (সানা) বরাত দিয়ে কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য জানিছে। সানা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে, সিরিয়ার রাজধানী লক্ষ্য করে ‘বিশ্বাসঘাতক ইসরায়েলের আগ্রাসনে’ তাদের টেলিভিশন উপস্থাপক সাফা আহমেদ নিহত হয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা এক ফুটেজে দেখা গেছে, রাস্তায় একটি গাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ইসরায়েলি হামলায় গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। তবে সিরিয়ায় হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
প্রতিবেশী লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনী ‘সীমিত’ আকারে স্থল অভিযান শুরুর পরেই সিরিয়ায় হামলার খবর সামনে এলো।
ইয়েমেনেও বড় হামলা: হুথি গোষ্ঠীকে টার্গেট করে ইয়েমেনেও বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। গত রোববার দেশটির বন্দরনগরী হোদেইদাকে লক্ষ্য করে হামলাটি চালানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামলার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়, হোদেইদার একটি জায়গা থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হচ্ছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলার জবাবেই পাল্টা এ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। গত এক মাসে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিনটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা।
হুথি বিদ্রোহীগোষ্ঠীর মুখপাত্র বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইয়াাহিয়া সারে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিমান ইসরায়েলে আসার পর তারা বেনগুরিয়ন বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছেন। হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয় বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/রন