logo
আপডেট : ৩ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:৫৭
বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টি র‌্যাগিং সেল গঠন জরুরি
ড. মো. শফিকুল ইসলাম

বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টি র‌্যাগিং সেল গঠন জরুরি

দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের কথা শুনতে হয় আমাদের। অতীতে গণমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুমসহ অনেক টর্চার সেল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে টর্চার সেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়। কিন্তু টর্চার সেলে যে নির্যাতন হয় তার বিচার হয় না বললেই চলে। নামমাত্র বিচার হয় কিছু ঘটনার।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এক নবীন শিক্ষার্থীকে মানসিক নির্যাতন ও মারধর করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অন্য একটি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ওই শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা নিয়ে নতুন শিক্ষার্থীরা খুবই আতঙ্কে থাকে।

এটি সমাজের জন্য বিব্রতকর। উক্ত শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসের নিজ কক্ষে র‌্যাগিং ও আবরার ফাহাদের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে, যা খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। তারপরও এই ঘটনা ঘটেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

গত বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় ১০টি লিখিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়ে। এমনকি দুই শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়বেনই না বলে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। নিরাপত্তা শঙ্কায় মেসও ছেড়েছেন রাবির সেই শিক্ষার্থী। অতীতে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে লিখিত আবেদন করেও বিচার না পেয়ে এক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়।

এ রকম অনেক লিখিত অভিযোগ দিলেও নানা চাপে প্রশাসন অনেক সময় বিচার করতে পারে না। আবার অনেক শিক্ষার্থী আরও নির্যাতনের ভয়ে কোনো অভিযোগ দেয় না। নীরবে সহ্য করে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নবীন শিক্ষার্থীদের এক নেতিবাচক সংস্কৃতির মধ্যে পড়তে হয়, যা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে কাজ করে। এ জন্য অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে বাধ্য হন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি লোক-প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র তার বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের কয়েক শিক্ষার্থী কর্তৃক র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়। এখানে বড় ভাইদের চিনতে না পারায় তাকে চড়-থাপ্পড় এবং গালাগাল করা হয়। এ ছাড়া রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জুনিয়র শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছিল একই বিভাগের কয়েক সিনিয়র শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। পরে তার বিভাগের শিক্ষকরা অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধান করে দেয়।

আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মধ্য রাতে ডেকে নিয়ে নবীন শিক্ষার্থীর ওপর চালানো হয় বর্বরতা। আহত শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কাতরাচ্ছে - এমন অবস্থা হয়েছিল। মা-বাবা কী যে দুশ্চিন্তায় ছিল তা বলে বোঝনো যাবে না। সেই ঘটনারও তেমন কোনো বিচার হয়নি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেভাবে র‌্যাগিংয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে বুঝতে পারি, কতটা বেপরোয়া ছিল নির্যাতনকারীরা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে ভয়ে থাকে, তাকে র‌্যাগিংয়ের শিকার হতে হয় কি না! এসব নির্যাতন এবং র‌্যাগিং কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এসব বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্যাতন ও র‌্যাগিংবিরোধী আইন করা উচিত।

শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদ পরিবেশে নির্ভয়ে পড়াশোনা করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‌্যাগিং বন্ধে নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে ইউজিসিকে। তা হলে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। সন্ত্রাস ও র‌্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক থাকতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কেন শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হবে? কোথাও কোথাও এমনকি শিক্ষকরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসব কোনোটাই সভ্য সমাজে কাম্য নয়। যদি কেউ কোনো অপরাধ করে থাকে, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আমরা কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছি? বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্ত চিন্তার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এসব টর্চার সেল বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এগুলো কখনো দেখিনি। যারা এসব করে, তারা কোনো আদর্শ বা চেতনা ধারণ করে না। কিছু বখাটে ছাত্র কোনো একটি সংগঠনের ছায়াতলে এসে এসব অপকর্ম করে থাকে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলব, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যোগ্য ও সঠিক আদর্শ বহনকারী ও মেধাবীÑ এসব বিবেচনায় নিয়ে নেতৃত্ব গড়ে তুলুন। তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় পাবে সঠিক নেতৃত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু এবং সুন্দর কর্মপরিবেশ না থাকলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, শুধু তদন্ত হয়। সে তদন্তের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ পায় না এবং বাস্তবায়নও হতে দেখা যায় না। তা হলে কীভাবে অন্যায় বন্ধ হবে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় নবীন শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে থাকবে। অনেক বিষয়ে শিক্ষকরাও আতঙ্কে থাকেন।

বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা জাতিকে কী বার্তা দিচ্ছে? সমাজে চরমভাবে অবক্ষয় হচ্ছে। এ জন্য সরকার, সাংবাদিক, শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের গুণী মানুষদের আরও সোচ্চার হতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নও ঘটে। তা হলে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে। সরকার দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছে। বিশ্ব বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনতে শুরু করেছে। এমন একটা সময়ে ছাত্র নামধারী কিছু মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করছে।

শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষার্থীদের মন থেকে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টি র‌্যাগিং সেল গঠন করতে হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সেলকে শক্তিশালী করাসহ অন্যান্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা, গবেষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের চর্চা হোক এবং অপরাজনীতি বন্ধ হোক - এ প্রত্যাশা করি। নতুন প্রজন্ম ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে এগিয়ে আসুক এবং গঠনমূলক রাজনীতি করে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখুক - এটাই হোক এ সময়ের ব্রত।

সঠিক রাজনীতির চর্চা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে, মায়ের বুক খালি করার রাজনীতি নয়। যারা সহপাঠীকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন এবং হত্যা পর্যন্ত করতে পারে, তারা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত এসব ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

 

ভোরের আকাশ/রন