সকাল ১০টা। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে বনানী ও রামপুরাগামী লেনে যানবাহনের জটলা। যাত্রী নিতে সড়কের পূর্ব পাশে আড়া-আড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে ২০-২৫টি বাস। সামনের বাস সরে যেতে পেছন থেকে ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছেন অন্য যানবাহনের চালকরা। অথচ সড়কের পাশের বোর্ডে লেখা ‘নীরব এলাকা’। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি-৪ অনুযায়ী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা ও তার উত্তর-দক্ষিণে দেড় কিলোমিটার (স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে হোটেল লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত) এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণার নির্দেশ দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। উপদেষ্টার নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পরিবেশ অধিদপ্তর, সড়ক বিভাগ, পরিবহন মালিক সমিতি। ১ অক্টোবর থেকে ওই এলাকা ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে কার্যকর হয়েছে। তবে এর একদিন পরে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে কাউকে এ নিয়ম মানতে দেখা যায়নি। যে যেভাবে পারছেন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজিয়েই চলেছেন। বাস-মোটরসাইকেল হর্ন বাজানোয় এগিয়ে। তবে কত মাত্রায় তারা হর্ন বাজাচ্ছেন তা নির্ণয় করা কিংবা তদারকি করার কাউকেও দেখা যায়নি। হর্ন যে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ তৈরি করে বাজানো হচ্ছে সেটা যেকোনো মানুষ উপলব্ধি করবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নীরব এলাকা কর্মসূচি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শব্দদূষণে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই কারণে-অকারণে হর্ন বাজিয়ে চলছেন চালকরা। তাই আইনের প্রয়োগ ছাড়া এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে যানবাহন চালকদের দাবি, ঢাকা শহরে সড়কে হর্ন ছাড়া যানবাহন চালানো সম্ভব নয়। কারণ, সড়কে পথচারীরা ট্রাফিক শৃঙ্খলা মানেন না। আবার সড়কের কোথাও জেব্রা ক্রসিং বা ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। ফলে যত্রতত্র সড়ক পার হন পথচারীরা। এমন পরিস্থিতিতে হর্ন না দিলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।
সরেজমিন দেখা যায়, উত্তরার স্কলাস্টিকা পয়েন্ট এলাকার ফুটপাতের ওপর একটি স্টিলের খুঁটিতে টাঙানো বোর্ডে লেখা ‘নীরব এলাকা শুরু : ঢাকা সড়ক বিভাগ’। একইভাবে দক্ষিণে লা মেরিডিয়ান পয়েন্টের সামনে নীরব এলাকার শুরু লেখা বিভিন্ন বোর্ড রয়েছে। কিন্তু এ সড়কের কোথাও হর্ন ছাড়া গাড়ি চলতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশপথের সামনে বেশি হর্ন বাজাতে দেখা যায়। এই সড়কে জনসচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছেন পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ভয়েসের সদস্যরা। কিন্তু চালকরা যেন তাদের কোনো কথাই শুনছেন না।
ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান খাদেম কবির। বিমানবন্দর স্টেশনের সামনে আলাপকালে তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুই চাকার যান। এ যান হর্ন ছাড়া চালানো প্রায় অসম্ভব। তারপরও যদি ট্রাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করা হতো তা হলে হর্ন না বাজিয়ে চলা সহজ হতো।
বনানীগামী একটি দ্বিতল বিআরটিসি বাসের চালক কামাল হোসেন বলেন, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে থেকে বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর প্রবেশপথে প্রচুর পথচারী সড়ক পার হন। এখানে ট্রাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং কিছুই নেই। ফলে এ পথে যাতায়াতের সময় বাধ্য হয়ে হর্ন বাজাতে হয়।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় হর্ন না বাজাতে ওই রুটে চলা সব বাস মালিক এবং চালককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেক বাসচালক নিয়ম মেনেই সেখানে গাড়ি চালাচ্ছেন। আশা করি ক্রমান্বয়ে হর্ন কমে আসবে।
শব্দদূষণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এই আইনে শাস্তি হিসেবে বলা আছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর সারাদেশে ১২টি নীরব এলাকা ঘোষণা করে। ঢাকায় পাঁচটি নীরব এলাকা রয়েছে। সবশেষ যুক্ত হয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা। আগে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয় সচিবালয়, আগারগাঁও, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকার কোনোটিতেই আইন অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’ বাস্তবায়ন হয়নি। সবগুলোতেই শব্দের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকা সচিবালয়ের ১২টি লোকেশনে শব্দের মাত্রা গড়ে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবেল। জাতীয় সংসদ এলাকায় ৭১ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এলাকায় ৭৫ দশমিক ৫৮ ডেসিবেল ও আগারগাঁও এলাকায় ৭২ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল।
পরিবেশবাদী সংগঠন পরিজার এক গবেষণায় দেখা যায়, আগে নীরব এলাকায় দিনে ৮৪ দশমিক ৫ থেকে ১০১ দশমিক ৭ ডেসিবেল এবং রাতে ৯৬ দশমিক ৪ থেকে ১০১ দশমিক ৫ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে। আবাসিক এলাকায় দিনে ৮২ থেকে ৯১ ডেসিবেল এবং রাতে ৮৩ থেকে ৯১ দশমিক ৬ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, শব্দদূষণ রোধে আমাদের যে দুটি আইন রয়েছে সেটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এছাড়া আইন অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ এলাকায় ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী পুরো ঢাকা শহরই নীরব এলাকা। কোথাও হর্ন দেওয়া যাবে না। আইন প্রয়োগ করতে গেলে এটা একটা বড় সীমাবদ্ধতা।
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, যেহেতু শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হলো হর্ন, এটি বন্ধ করতে পারলেই ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ শব্দদূষণ কমে যাবে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য আইনগত যে ভিত্তি রয়েছে সেটি দুর্বল।
ভোরের আকাশ/রন