আর্দ্রতাপূর্ণ অত্যধিক তাপমাত্রা (সেপ্টেম্বরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি হলেও অনুভূতি হয় ৪৮ ডিগ্রির), থেমে থেমে বৃষ্টি, আধুনিকতায় অভ্যস্ত নাগরিক জীবনযাপন প্রণালি, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, নগরের অধিকাংশ বাসাবাড়িতে পানি ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিণত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, সব মিলিয়ে অসহনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছি আমরা। এসব করণে এসময় প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রমণের সংখ্যা এবং সঙ্গে রয়েছে মৃত্যুও।গত ২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ৯৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৭৪ জনের, যদিও গত বছরের তুলনায় সংখ্যাটা অনেক কম।
গত বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০৫ জন। আমাদের জন্য যা খুবই বেদনাদায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বৈরী পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (ফিলিপাইন, ভারত, ব্রাজিল ইত্যাদি) ডেঙ্গু জ্বরের অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশে মৃত্যু হার অনেকটা বেশি (০.৫%-এর ওপরে)। রোগীর এই মৃত্যুর হার কম-বেশি হয় মূলত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে।
এডিস মশার উৎপাতে জুলাই-অক্টোবরে দেশবাসী ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। এডিস মশা পৃথিবীব্যাপী ডেঙ্গু জ্বর অথবা ব্যাকবোন ডিজিজের জন্য মূলত দায়ী। এটি ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি (০৪) সেরোটাইপবাহী অন্যতম আরবোভাইরাস ডিজিজ। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু আউটব্রেক হয় ২০০০ সালে; যাতে ৯৩টি তাজা প্রাণের বিসর্জন হয়।
ডেঙ্গু মহামারিরূপে বৃদ্ধির জন্য মূলত ৩টি কারণকে দায়ী করা হয়:
১) বর্ধিত/ অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং এর ফলে শহরে ডেট্রিটাস এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বর্ধিত ভেক্টর প্রজনন এবং মানুষ ও ভেক্টরের (ভাইরাসবাহী মশা) মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি।
২) প্রধানতম ভেক্টর মশার বিশ্বব্যাপী আক্রমণ: মশার চারটি ভাইরাসের সেরোটাইপের ভৌগোলিক বিস্তার এবং ওভারলেপিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি।
৩) চারটি সেরোটাইপের মিথস্ক্রিয়ার এবং বিবর্তনের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি।
ঢাকা মহানগরী ও এডিস মশা: ঢাকা জেলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা এবং সংলগ্ন কয়েকটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। ২০১১ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৭৬ জন লোক বাস করতো। সেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৯ জন। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (৫৯,৭৯,৫৩৭ জন) এবং ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশন সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯,৩৫৩ জন) জনসংখ্যা ৪২,৭৯,৩৪৫ জন। ঢাকা বিভাগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ১.৭৪%।
দুই প্রজাতির এডিস মশা দেখতে কালো রঙের, পায়ে ও মাথায় সাদা ডোরা কাটা দাগ আছে। এজিপটাইয়ের মাথায় সাদা কাস্তের মতো দাগ আছে, আর এলবোপিকটাসের মাথার মাঝ বরাবর সাদা দাগ আছে। অন্যান্য মশার মতো এডিস মশাও জীবনের একটা অংশ পানিতে কাটায়। তাদের অপূর্ণাঙ্গ দশা অর্থাৎ ডিম, লার্ভা, পিউপাল স্টেজ সম্পন্ন করার জন্য পানি অপরিহার্য।
ডিম: পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা (ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্ম নিতে ৭-১০ দিন লাগে) জন্মলাভের পরপরই অতি দ্রুত (২ দিনের মধ্যে) ম্যাটিং সম্পন্ন করার পর ডিম পাড়া শুরু করে। ডিমগুলো দেখতে কালো রঙের, এককভাবে পানিযুক্ত পাত্রের আর্দ্রপৃষ্ঠে জলরেখার কাছাকাছি ডিম পাড়ে এবং ডিমগুলোতে আঠালো উপাদান থাকায় পাত্রের গায়ে সহজে লেগে থাকে। এডিস মশা এক জীবনে অন্তত তিনবার ডিম পাড়ে, যাতে ১০০টির মতো ডিম থাকতে পারে।
লার্ভা: ডিম পানির সংস্পর্শে এলে ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে বাচ্চা তথা লার্ভা বের হয়ে আসে। লার্ভাগুলোর রেস্টলেস স্বভাব দেখে সহজেই চেনা যায়। তারা পানিতে সারাক্ষণ ছোটাছুটি করতে থাকে এবং পানিতে জমে থাকা ময়লা থেকে খাবার সংগ্রহ করে। এ অবস্থায় চারটি ইনস্টার অতিক্রম করে ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে পিউপা স্টেজে পৌঁছে যায়।
পিউপা: এ স্টেজে তারা কোনও খাবার গ্রহণ করে না এবং এভাবে ৩ থেকে ৪ দিন অতিক্রম করে। মূলত পূর্ণাঙ্গ মশা সৃষ্টির জন্য তারা একটা আবরণের মধ্যে নিজেকে আবৃত করে রাখে।
পূর্ণাঙ্গ মশা: পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্ম হওয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী মশা মূলত উদ্ভিদের রস খেয়ে জীবনযাপন করে। পুরুষ এডিস মশার জীবন অতি সংক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু স্ত্রী এডিস মশা ভবিষ্যৎ বংশধর তৈরির জন্য প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ করে। তারা বিভিন্ন প্রাণী থেকে রক্ত পান করলেও মানুষের রক্তকে বেশি পছন্দ করে। একটি স্ত্রী মশা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। স্ত্রী এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বেশি সক্রিয় থাকে। তারা মাটির পাত্র, কালো রঙ এবং বডি ওডরের (মানুষের গায়ের গন্ধ: রক্তের গ্রুপ একই হলেও কাউকে বেশি কামড়ায় আবার কাউকে কম) প্রতি বেশি আকর্ষিত হয়। অসক্রিয়/রেস্টির সময়গুলোতে তারা ঘরের মধ্যে বিভিন্ন জিনিসে, যেমন- পর্দার আড়ালে, টেবিল বা খাটের নিচে ইত্যাদি জায়গায় সংগোপনে অবস্থান করে।
বংশবৃদ্ধির স্থান: বাংলাদেশের বেশিরভাগ সিটি করপোরেশনে নাগরিক জীবনযাপন প্রণালি একই রকম। জীবনযাপনে আধুনিকীকরণের ফলে দৈনন্দিন খাবার গ্রহণ, পানীয় জল, ড্রাই ফুডসহ অন্যান্য ধরনের স্নাক্স/ফুড প্রক্রিয়াজাতকরণে, প্লাস্টিক জাতীয় নন- বায়োডিগ্রেডেবল মেটেরিয়ালসের ব্যবহার আধিক্য রয়েছে। এই ধরনের নন-বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলা হয় এবং বৃষ্টির পানি জমার উপযুক্ত স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।
তাছাড়া নগরে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, উন্মুক্ত স্থানে অকেজো মালামাল (টায়ার, ভাঙা গাড়ি, অব্যবহৃত ঢাকনাবিহীন বা ব্যবহৃত ড্রাম, মাটির ছোট-বড় পাত্র, চৌবাচ্চা, সিমেন্টের ট্যাংক ইত্যাদি) সংরক্ষণ, বাসাবাড়ি, ঘরের আঙ্গিনায়, রুফটপ এবং ইনডোরে প্ল্যান্ট রাখার প্রবণতাও এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ন্যাচারাল ব্রিডিং হ্যাবিট, যেমন– গাছের কোঠোর, লিফ-এক্সিল ইত্যাদিও অ্যালবোপিকটাস মশাসহ এডিসের অন্য কয়েকটি প্রজাতির মশার বংশবৃদ্ধির আবাসস্থল।
ভাইরাস: ডেঙ্গু ভাইরাস একটি আণুবীক্ষণিক এজেন্ট। এই ভাইরাসটি মানুষের দেহে সংক্রমণের আগে স্ত্রী এডিস মশার শরীরে জীবনের একটি পর্যায় অতিবাহিত করে নিজেকে সংক্রমণের উপযোগী হিসেবে প্রস্তুত করে। কোনও ব্যক্তি যদি প্রথমবার চারটি টাইপের মধ্যে যেকোনও একটি সেরোটাইপের দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে তার অন্যান্য নরমাল ফিভারের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যাকে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গি বলে। পরবর্তীতে ওই একই ব্যক্তি সময়ের ব্যবধানে পুনরায় অন্য একটি সেরোটাইপবাহী মশা দিয়ে আক্রান্ত হলে এটি জটিল আকার ধারণ করে এবং অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়– যদি প্রথমবার কোনও ব্যক্তি কোনও একটি সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তার শরীর ওই সেরোটাইপের জন্য অ্যান্টিবডি (শরীরকে প্রোটেকশন জন্য বিশেষ প্রোটিন) তৈরি করে তাকে ওই সেরোটাইপের পুনঃআক্রমণ থেকে মুক্ত রাখে, অন্য সেরোটাইপের জন্য নয়। মানুষ শুধু ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী স্ত্রী এডিস মশার (যে মশাটি ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ানোর মাধ্যমে নিজের শরীরে ভাইরাসকে বহন করে) কামড়ানোর মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় (মানুষ-মশা-মানুষ)।
মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কার্যক্রম: পারিবারিক সচেতনতা, ব্যক্তি পর্যায়ে মশামুক্ত পরিবেশ তৈরি, বাসাবাড়িতে কেন্দ্রীয়ভাবে সার্ভিলেন্স কার্যক্রম নিবিড় পর্যবেক্ষণসহ অপূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণ/ দমনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন একযোগে কাজ করার জন্য গবেষণাসহ কার্যকর টেকসই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। যেমন- মশা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম নির্ধারণপূর্বক ওয়ার্ডভিত্তিক মশার ঘনত্ব নির্ণয়পূর্বক মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার।
১. মশার অপূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণাঙ্গ দশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক মাত্রায় যথাযথভাবে গরিবেশবান্ধব কীটনাশক ব্যবহার করা।
২. মশা নিয়ন্ত্রণে আবহাওয়া উপযোগী ও এতদসংশ্লিষ্ট উপযুক্ত মডেল ব্যবহার করার জন্য সামষ্টিক উদ্যোগ নেওয়া।
৩. সুনাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে নিজের ভেবে যত্রতত্র বোতল, খাবার কৌটা, অব্যবহৃত-অপচনশীল যেকোনও জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
৪. খুদে শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলিতে বা শ্রেণি কার্যক্রমে এ ধরনের বাহক মশা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
৫. বয়োবৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই নিজের প্রয়োজন অনুসারে মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রটেকশন (যেমন- ফুলহাতা পোশাক, অ্যান্টি মসকিউটো লোশন ব্যবহার, ঘরে সকাল ও বিকালে এরোসল ব্যবহার ইত্যাদি এবং প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন পানি জমানো পাত্রগুলো ঘষেমেজে পুনরায় ব্যবহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ) নেওয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
৬. অফটাইমে (জানুয়ারি-জুন)/ অনটাইমে (জুলাই-নভেম্বর) ডেঙ্গু রোগী সম্পর্কে ওয়ার্ড/ ইউনিয়নভিত্তিক জরুরিভাবে তথ্য নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, কারও জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া।
৭. সোর্স রিডাকশান করার জন্য বছরব্যাপী প্রান্তিক পর্যায়ে সার্ভিলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করা।
৮. ফাইন্যান্সিয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং সিটি করপোরেশনে আধুনিক গবেষণা কার্যক্রমসহ মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য টাস্কফোর্স টিম গঠন করে (ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২০০১-২০০২ সালের মডেলকে বেইজ করে) বিশেষজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনের নিরিখে সময়োপযোগী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের বায়ো কীটনাশক (যেমন- বেসিলাস থুরেনজেনেসিস) মশার কয়েলের মতো ব্যবহার উপযোগী ও সহজলভ্য করে জনগণের নাগালে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ।
বর্তমান সরকার পণ্য পরিবহনে পলিথিনের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করায় ভবিষ্যতে পরিবেশ সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা রাখি। প্রিয় বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক সুরক্ষিত থাকবে প্রথমে নিজে যদি সচেতন হই। আর এই সচেতনতা শুরু হোক পরিবার থেকে। এটাই হোক সময়ের অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক ও কীটতত্ত্ববিদ
ভোরের আকাশ/রন